• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

লিভার প্রতিস্থাপন বলতে কী বোঝায়?

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৩  

লিভার ট্রান্সপ্লান্ট (প্রতিস্থাপন) হলো একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যেখানে সঠিকভাবে কাজ করে না এমন লিভারটিকে সুস্থ লিভার বা জীবিত দাতা বা মৃত দাতার কাছ থেকে লিভারের একটি অংশ প্রতিস্থাপন করা হয়। একটি লিভার ট্রান্সপ্লান্টকে হেপাটিক ট্রান্সপ্লান্টেশনও বলা হয় যা আহত বা অসুস্থ লিভারকে অপসারণ করে এবং একটি সুস্থ লিভার দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। প্রতিস্থাপনের এই প্রক্রিয়াটি অ্যালোগ্রাফ্ট নামেও পরিচিত। লিভারের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে এটি সম্ভাব্যভাবে মানুষকে বাঁচাতে পারে।

লিভার বা যকৃৎ হলো একটি আবশ্যিক প্রত্যঙ্গ, যা পাচকনালী থেকে আসা রক্তকে পরিশ্রুত করে পুরো শরীরে ছড়িয়ে দেয়। পেশি গড়ে তুলতে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ও রক্তকে জমাট বাঁধতে না-দেওযার জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যালকে বিষমুক্ত বা ডিটক্সিফাই করা, ওষুধপত্রকে বিপাক বা মেটাবলাইজ করা এবং প্রোটিনকে সংশ্লেষিত বা সিন্থেসাইজ করার কাজ করে।

লিভার প্রতিস্থাপন কী?

লিভার প্রতিস্থাপন হলো এমন এক সার্জারি যার মাধ্যমে অসুস্থ লিভারকে সরিয়ে তার জায়গায় সুস্থ লিভার বসিয়ে দেওয়া হয়। লিভার যখন পর্যাপ্ত ভাবে কাজ করতে পারে না (লিভার বিকল হয়ে যায়) তখন লিভার প্রতিস্থাপন করার কথা ভাবা হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের লিভার প্রতিস্থাপন করা হয় মূলত সিরোসিস হলে এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হয় বাইলিয়ারি আট্রেজিয়া হলে। ভাইরাল হেপাটাইটিস, লিভার ক্যানসার ও বংশগত রোগ হলেও লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে।

লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি:

জীবিত লিভার-দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন সার্জারিতে জীবিত ও সুস্থ দাতার লিভারের একটা অংশকে বের করে এনে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটা সম্ভব হয় কেননা লিভারের ক্রিয়াশীলতাকে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা বিশাল (৭০%) এবং এর পুনর্গঠিত হয়ে ওঠার ক্ষমতাও আশ্চর্য রকমের। দাতা ও গ্রহীতা দুজনেরই লিভারের অংশগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্বাভাবিক আকৃতি পেয়ে যায়।

মৃত লিভার দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন সার্জারিতে দাতার মস্তিষ্ক চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যায় এবং এই অবস্থার পুনরুদ্ধার করা যায় না। মৃত ব্যক্তির অন্যান্য প্রত্যঙ্গের মতো লিভারও দান করা হয় তার নিকটতম আত্মীয়ের সম্মতি নিয়ে।

 

লিভার প্রতিস্থাপনের অপারেশন করতে সাধারণত ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। অসুস্থ লিভারকে বের করে এনে তার জায়গায় দাতার লিভার বসানো হয়। নতুন লিভার প্রতিস্থাপন করার আগে সার্জন অসুস্থ লিভারকে পিত্তনালী ও রক্তনালী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।

নতুন লিভার যাতে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে থাকে এবং শরীর যাতে নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করতে না-পারে, তার জন্য প্রতিস্থাপন পরবর্তী পরিচর্যা, যেমন ওষুধপত্র খাওয়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয় হাসপাতালে এবং বাড়িতে। সফল ভাবে লিভার প্রতিস্থাপন হলে পর একজন ব্যক্তি ফের তার কাজের জগতে, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।

লিভার প্রতিস্থাপন য়োজন হয় কখন?

গুরুতর লিভার রোগ হলেই লিভার প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। এই রোগের নানা কারণ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের লিভার প্রতিস্থাপন করার সবচেয়ে বড় কারণ হল সিরোসিস। এই সিরোসিস হলে লিভার আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে এবং ক্রনিক আঘাতের ফলে অকেজো হতে শুরু করে। খারাপ কোষকলা লিভারের সুস্থ কোষকলার জায়গা দখল করে। এরা লিভার থেকে হওয়া রক্তপ্রবাহকে বাধা দেয় আংশিক ভাবে। সিরোসিস নানা কারণে হয়। যেমন হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, মদ্যপান, লিভারের স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগ, লিভারে চর্বি জমা হওয়া ও বংশগত লিভার রোগ। অত্যধিক মদ্যপান করার ফলে লিভারে সিরোসিস হওয়া বহু লোকেরও লিভার প্রতিস্থাপন করার দরকার হয়। বহু রোগীই আবার দীর্ঘদিন লিভার প্রতিস্থাপন না-করেও বেঁচে থাকতে পারেন। তাদেরকে শুধু মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হয় এবং ৬ মাস ধরে লিভার সংক্রান্ত নানা সমস্যার চিকিৎসা করাতে হয়। তবেই তাদের লিভার বেশ ভালো ভাবেই সুস্থ হয়ে ওঠে। যেসব রুগির লিভার রোগ খুব বেড়ে যায় এবং বহুদিন ধরে মদ্যপান থেকে বিরত থেকে ও চিকিৎসা করা সত্ত্বেও যাদের লিভার সেরে ওঠে না, তাদের জন্য লিভার প্রতিস্থাপনই হল একমাত্র চিকিৎসা।

প্রতিস্থাপনের জন্য লিভার কোথা থেকে আসে?

লিভার প্রতিস্থাপনের দুটি বিকল্প আছে: জীবিত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন এবং মৃত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন।

যেসব রুগির এন্ড-স্টেজ লিভার রোগ হয়েছে, তাদের জন্য জীবিত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সুস্থ ও জীবিত দাতার লিভারের একটা অংশ নিয়ে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দাতা ও গ্রহীতা, দুজনেরই লিভারের অংশগুলো বেড়ে স্বাভাবিক আকৃতি পেয়ে যায়।

রুগির রক্তের সম্পর্কের ব্যক্তি, স্বামী/স্ত্রী বা বন্ধু লিভার-দাতা হতে পারেন। প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারা ঝুঁকিকে যতটা সম্ভব কম করার জন্য দাতার চিকিৎসা সংক্রান্ত ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের গভীর মূল্যায়ন করা হয়। কে উপযুক্ত দাতা হতে পারেন, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রক্তের প্রকার ও শরীরের আকৃতি। প্রতিস্থাপন সার্জারির আগে জীবিত দাতাদের ও তাদের থেকে নেওয়া লিভারকে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। এইসব টেস্ট করে দেখা হয় যে লিভার যেন সুস্থ থাকে, আপনার রক্তের প্রকারের সঙ্গে যেন মিলে যায় এবং এর আকৃতিও যেন ঠিক থাকে, যাতে আপনার শরীরে এই লিভার খুব ভালো করে কাজ করার সুযোগ পায়।

যে গ্রহীতার শরীররে জীবিত দাতার লিভার প্রতিস্থাপন করা হবে তাকে প্রতিস্থাপনের প্রতীক্ষারত তালিকায় সক্রিয় থাকতে হবে। তাদের স্বাস্থ্যও যথেষ্ট মজবুত হতে হবে, যাতে তাদের শরীরে প্রতিস্থাপন সর্বোত্তম সফল ভাবে করা যেতে পারে।

মৃত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মৃত ব্যক্তি হয়তো দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন, বা তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল বা মাথায় চোট পেয়েছিলেন। এই অবস্থায় দাতার হৃদযন্ত্র তখনও সক্রিয় থাকে, কিন্তু তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এমন ব্যক্তিকে আইনত মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়, কারণ তার মস্তিষ্ক চিরকালের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং তার মস্তিষ্ককে পুনরায় সক্রিয় করে তোলা যায় না। এই সময়টাতে দাতাকে সাধারণত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। পুরো লিভারটাই সদ্যমৃত ব্যক্তির থেকে বের করে আনা হয়। এমন ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়ের সম্মতি নিয়ে লিভার নেওয়া হয়। মৃত দাতা এবং তার মৃত্যুকে ঘিরে থাকা পরিস্থিতিগুলোকে গোপন রাখা হয়।

লিভার প্রতিস্থাপন করা কি সুরক্ষিত?

লিভার প্রতিস্থাপন করাটা সুরক্ষিত। কারণ, লিভারের সংরক্ষণ ক্ষমতা খুব বেশি এবং এর একটা অংশ বের করে আনার পর (২-৩ মাসের মধ্যে) এটা পুনর্গঠিত হয়ে নিজের প্রকৃত আকৃতি পেয়ে যায়। দাতার স্বাস্থ্যে এর কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে না, তাকে ২-৩ সপ্তাহের বেশি ওষুধ খেতে হয় না এবং এক মাসের মধ্যেই তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তিন মাসের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ (ভারী জিনিস তোলা ইত্যাদি) করতে পারবেন।

সার্জারি করতে কত সময় লাগে?

লিভার প্রতিস্থাপন করতে সাধারণত ৪ থেকে ১৪ ঘণ্টা লাগে। অপারেশনের সময় সার্জনরা আপনার লিভারকে বের করে এনে তার জায়গায় দাতার লিভার বসিয়ে দেবেন। আপনার অসুস্থ লিভারকে বের করে আনার আগে সার্জন ওই লিভারকে আপনার পিত্তনালী ও রক্তনালী থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন। লিভার থেকে প্রবাহিত রক্তকে মেশিনের সাহায্যে আটকে দিয়ে আপনার শরীরের বাকি অংশে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সার্জন এরপর সুস্থ লিভারটাকে সঠিক জায়গায় বসিয়ে সেটাকে আপনার পিত্তনালী ও রক্তনালীর সঙ্গে যুক্ত করে দেন। প্রতিস্থাপনের অপারেশনটা খুব বড়সড় একটা চিকিৎসা পদ্ধতি বলে সার্জনরা আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশে টিউব লাগিয়ে রাখেন। অপারেশনের সময় এবং তারপরেও আরও কয়েক দিন আপনার শরীর যাতে নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে যেতে পারে, তার জন্যই এই টিউবগুলোর প্রয়োজন হয়।

পুরো সুস্থ হয়ে ওঠার সময় কী হয়?

শুরুতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আপনার লিভার সহ পুরো শরীরের ক্রিয়াকলাপের উপর খুব ভাল করে নজর রাখার কাজটা করা হয়। রোগীকে একবার ওয়ার্ডে পাঠানো হয়ে গেলে ঘন ঘন তার রক্ত পরীক্ষা করানোর মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়, খাওয়াদাওয়া করতে দেওয়া হয়, পেশিকে ফের মজবুত করে তোলার জন্য ফিজিওথেরাপি করতে দেওয়া হয়। শরীর যাতে নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করতে না-পারে, তার জন্য শুরুতে শিরার মাধ্যমে এক বা একাধিক ওষুধ শরীরে ঢোকানো হয়, পরে আস্তে আস্তে ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। প্রতিস্থাপনের সময় লিভারের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং প্রত্যাখ্যানের কোনও লক্ষণকে শনাক্ত করার জন্য ঘন ঘন নানা টেস্ট করানো হয়।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা