• শনিবার ০১ জুন ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১৮ ১৪৩১

  • || ২৩ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

তামিমের মুখে ক্রাইস্টচার্চ হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০১৯  

সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডে ঘটে গেল বর্বরোচিত ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। আর সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। ঘটনাটা খুলে বলেছেন তামিম ইকবাল। তার প্রতিটি কথা রুদ্ধশ্বাস ও আঁতকে উঠার মত। যেন কোন এক থ্রিলার মুভির কাহিনী। দলের এই ওপেনার বলেন, ‘বাসে ওঠার আগে কী হয়েছে তা খুলে বলছি। এতে বুঝতে পারবেন ওই দু-তিন মিনিট কীভাবে আমাদের সব পাল্টে দিয়েছে।’ খেলা বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোকে দেওয়া তামিমের সেই বর্ণনা তুলে ধরা হলো-

সাধারণত মুশফিক ও রিয়াদ ভাই খুতবার সময় উপস্থিত থাকতে চান। এ কারণে আমরা একটু আগেই জুমার নামাজে যেতে চেয়েছি। আমাদের বাস ছাড়ার কথা ছিল দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে, কিন্তু রিয়াদ ভাই সংবাদ সম্মেলনে যান। সেখানে একটু দেরি হয়ে যায়। সংবাদ সম্মেলন শেষে তিনি ড্রেসিংরুমে ফিরে আসেন।

ড্রেসিংরুমে আমরা ফুটবল খেলছিলাম। তাইজুল হারতে চাচ্ছিল না, কিন্তু সবাই ওকে হারাতে চাচ্ছিল। তাইজুল আর মুশফিক দুজনে খেলছিল, এতে কয়েক মিনিট দেরি হয়ে যায়। এই ছোটখাটো বিষয়গুলোই আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এরপরই আমরা বাসে চড়ে বসি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল নামাজ শেষে হোটেলে ফিরব, এ কারণে শ্রী (দলের বিশ্লেষক শ্রীনিবাস চান্দ্রাসিকারান) ও সৌম্য আমাদের সঙ্গে গিয়েছে। তারা দুজনে মুসলিম না। তাছাড়া সেদিন অনুশীলন ছিল ঐচ্ছিক। তাই যার ইচ্ছা হোটেলে যেতে পারবে। আর যার ইচ্ছা অনুশীলন করতে পারবে।

 

তামিমের মুখে ক্রাইস্টচার্চ হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা

দেশের আসার সময় বিমানবন্দরে টাইগাররা। ছবি: ক্রিকইনফো

আমি সব সময় বাসের ছয় নম্বর সিটের বাঁ পাশে বসি। যখন মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছি, তখন আমার ডান পাশের সবাই জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। আমি দেখলাম, মেঝেতে একটা দেহ পড়ে আছে। আমরা এটাকে মাতাল অথবা অচেতন মনে করেছিলাম। সুতরাং বাস এগিয়ে গিয়ে মসজিদের কাছাকাছি দাঁড়াল। কিন্তু সবার মনোযোগ ছিল পড়ে থাকা সেই দেহটি ঘিরে।

এসময় আমরা দেখলাম রক্তাক্ত একটি শরীর আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে। বললাম এসব কি হচ্ছে। ঠিক এই সময় ভয়টা শুরু হলো।

মসজিদের কাছাকাছি এসে একটি গাড়ির সামনে আমাদের বাস দাঁড়ায়। আমরা দেখলাম যে, বাসচালক এক নারীর সঙ্গে কথা বলছেন, যিনি কাঁপছিলেন এবং কাঁদছিলেন। উনি বলছিলেন, ‘সেখানে গোলাগুলি হচ্ছে, ওখানে যেয়ো না, ওখানে যেয়ো না।’

বাসচালক নারীকে বললেন, ওরা মসজিদে যাচ্ছেন। নারী জবাব দিলেন, ‘না না না, মসজিদে যেয়ো না। গোলাগুলি তো মসজিদেই হচ্ছে।’

এরপর তিনি আবার কাঁদতে শুরু করলেন। সবাই তার কথা শুনেছে ও দেখেছে, ফলে ভয় আমাদের আরও বাড়ল। তখন আমরা মসজিদ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে। তাই বাস থেকে নেমে মসজিদে ঢুকব। এসময় দেখলাম, মসজিদের আশপাশে বেশ কিছু রক্তমাখা শরীর পড়ে আছে।

 

তামিমের মুখে ক্রাইস্টচার্চ হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা

ভয়াবহ এই ঘটনার সাক্ষী টাইগাররা। মাঠে ফিরে আসছেন তামিমরা। ছবি: সংগৃহীত

যখন আমরা আরও লাশ দেখলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম না আমাদের ঠিক কী করা উচিত। এসময় অনেকেই ভয়ে মাথায় পরা নামাজের টুপি খুলে ফেললেন। যারা পাঞ্জাবি পরে ছিলেন, তারা পাঞ্জাবির উপরে জ্যাকেট পরতে শুরু করলেন। এ ছাড়া আর কীই বা করার আছে?

তখন আমরা শুধু বাসের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। এভাবে সাত কিংবা আট মিনিট কাটল। আমরা ঠিক কী ঘটছে তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমরা বুঝতে পেরেছি সেখানে সহিংস কিছু ঘটছে।

আমরা ভীষণ ভয় পেতে শুরু করি। দেখুন আমাকে, আমি ঠিকমতো কথা বলতে পারছি না। আমরা বাসচালককে বললাম, এখান থেকে আমাদের বের করুন। কিছু একটা করুন। কিন্তু তিনি সরলেন না। সবাই চিৎকার শুরু করল। ওই ছয় কিংবা সাত মিনিট সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না।

এরপর হঠাৎ করেই পুলিশ এলো, এবং ওদের বিশেষ বাহিনী ঝড়ের বেগে মসজিদে ঢুকল। আমার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।রক্তমাখা শরীর নিয়ে আরও অনেকে মসজিদ থেকে বের হতে শুরু করলো।

ঠিক এই সময় আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আমরা চিৎকার করতে শুরু করি, ‘আমাদের যেতে দাও’। কেউ একজন বলল, ‘আমরা যদি বাস থেকে বের হই তখন যদি গুলি করে?’ আবার কেউ বলল, ‘বাসে থাকলে আমরা বিপদে পড়ব।’

আমারও তাই মনে হলো, বাস থেকে বের হতে পারলে পালানোর সুযোগ পাব। অন্যথায় বাসে আমরা বড় লক্ষ্যবস্তু হব। কিন্তু আমরা যাব কোথায়? দুটি দরজাই তো বন্ধ। আমরা তখন ভেঙে পড়েছি। মাঝের দরজায় ধাক্কা ও লাথি মারতে শুরু করি। এসময় বাসচালক দরজা খুললেন। এভাবে আট মিনিটি পর শেষ পর্যন্ত বাস থেকে নামলাম। সবাই বলছিল, পার্ক দিয়ে দৌড় দিই। কেউ বলল, পার্কে আমরা সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হব। যদি বন্দুকধারী আমাদের দেখে গুলি করতে শুরু করে?

 

তামিমের মুখে ক্রাইস্টচার্চ হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা

মসজিদের পাশে লাশ পড়ে আছে। ছবি: সংগৃহীত

এই সময় আমি আপনাদের তিনজনকে আসতে দেখলাম (সাংবাদিক ইসাম, উৎপল শুভ্র এবং মাজহার উদ্দিন)। আপনাদের দেখে কিছুটা শান্ত হই, এবং হাঁটতে শুরু করি। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবাই মাঠের (ওভাল) দিকে দৌড়াতে শুরু করি। তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু কাল রাতে বুঝলাম, আপনারা কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এই সময় পৃথিবীর খু্ব কম মানুষ এমন ঝুঁকি নেয়। ওই রকম পরিস্থিতিতে কাছের মানুষেরাও হয়তো আপনাদের মতো ভূমিকা নেয় না। আপনি জানেন, মৃত্যুকে নিজের চোখে দেখে এসেছি। এটা এমন বিষয় যা আমরা সারা জীবনে ভুলতে পারব না।

বিমানবন্দরে আসার পথে আমরা বলছিলাম, একটু এদিক-সেদিক হলেই আমরা নয়, আমাদের লাশগুলো ঘরে ফিরত। এটা মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যাপার।

গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে ৫০ জন মারা যান। দ্যা টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, হামলাকারী নিজেকে ব্রেনটন ট্যারেন্ট বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। ২৮ বছর বয়সী একজন শ্বেতাঙ্গ। তাকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হয়।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা