• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

পারলে শেখ হাসিনাই পারবেন

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০১৯  

পৃথিবীতে যেদিন থেকে গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে সেদিন থেকেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সরকারের সমর্থক, শুভাকাঙ্খী কিংবা পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ারও রীতি চালু হয়েছে। ইউরোপ কিংবা আমেরিকা যেখানে গণতন্ত্র নিয়ে অহং চরম ও তীব্র রূপ নিয়েছে সেখানে যেমন, তেমনই ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও রাজনৈতিক নিয়োগ সিদ্ধ এবং প্রচলিত। আমেরিকার মতো দেশেতো প্রয়োজনে সরকারের সাচিবিক পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও দলীয় তথা প্রেসিডেন্টের পছন্দসই ব্যক্তিদের দ্বারা পূরণ করা হয়ে থাকে। এর ফলে সরকারের নীতি ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হওয়াসহ বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির বিরোধিতা থেকেও রাজনৈতিক সরকারকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়।

তাছাড়া যে কোনো সরকারই চায় পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে, রাজনৈতিক নিয়োগ দিয়ে সেই নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করাটাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সরকার রাজনৈতিক দলেও প্রশাসনকে রাজনীতির বাইরে রাখা হয়েছে, তাতে ফল কী হয়েছে সে আলোচনায় পরে আসছি কিন্তু তার আগে এই প্রশ্ন তোলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রশাসনকে রাজনীতি-মুক্ত রাখতে গিয়ে আদৌ সেটা কোনো কাজে আসছে কি না?

 আজকে শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নরোধে প্রশাসনকে নিয়েই মাঠে নেমেছেন বলে প্রতীয়মান। এতে প্রশাসনকেও একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছে পরোক্ষভাবে যে, তারাও যেনো সাবধান হয়ে যান। এরই মধ্যে আমরা প্রশাসনের বেশ কয়েকটি ‘গ্রস’ দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে বলেই জানতে পেরেছি, হয়তো আরও অনেক কিছুই আমরা এখনও জানিনে। যেহেতু প্রশাসন রাজনৈতিক ভাবে নিয়োজিত নয় বরং কথিত ‘রাজনীতি-নিরপেক্ষ’ সেহেতু এসব দুর্নীতির দায়ও আসলে এসে পড়ছে রাজনৈতিক সরকারের গায়েই। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার সরকার শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেন সেটাও জনগণ দেখতে চায়। তিনি যদি এক্ষেত্রেও কঠোর হতে না পারেন তাহলে বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক সরকার সেটা পারবে না- এটাও একটি চরম ও তিক্ত সত্য 

একথা আমরা হয়তো মানতে চাই না যে, অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও সরকার পরিচালিত হয় মূলতঃ প্রশাসনের দ্বারাই। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও তাদের নির্দেশে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক সময়ই দেখা যায় রাজনৈতিক সরকারগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় প্রশাসনের হাতে। এমনকি প্রশাসন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলি রাজনৈতিক সরকারকে সবদিক থেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেদের ‘কিং মেকার’ হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টিরও নজির আমরা দেখতে পাই অনেক দেশেই। বিংশ শতাব্দীতে এরকম দেশগুলিতে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে প্রয়োজন প্রশাসন ও সেনাবাহিনী দিয়ে জনপ্রিয় সরকারপ্রধান কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার ঘটনাও আকছার ঘটেছে। একবিংশ শতকে এসে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরালেও প্রশাসন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীগুলির ক্ষমতা ও ক্ষমতা-চর্চা কোনো অংশে কমেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এদেরকে বশে রেখে রাজনৈতিক সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিও যে দেশে দেশে ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে তার নজিরও আমাদের সামনে রয়েছে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি খুব সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করতে পারছে না- এ জন্য এদেশের সুশীল সমাজ (যারা মূলতঃ বিদেশি অর্থসাহায্যে পুষ্ট) রাজনৈতিক দলগুলোকে ঢালাওভাবে দায়ী করে আসছে সেই নব্বইয়ের দশক থেকে, যখন বাংলাদেশে নতুন করে গণতন্ত্র পা ফেলতে শুরু করে। কিন্তু এ প্রশ্ন খুব কমই উচ্চারিত হয়েছে যে, সেনা শাসনের জঠর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কেন বা কী কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজস্ব শক্তিতে দাঁড়া হওয়ার সুযোগ দেবে? তার চেয়ে বরং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিয়োজিত বাহিনীগুলিকে ক্ষমতার অংশীদার করে নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল রেখে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাই কি এই সকল বাই-প্রোডাক্ট রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়? আর এক্ষেত্রে প্রকৃত ও জনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে এককভাবে এইসকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা যে সম্ভবপর নয় বা তাদেরকে সে সুযোগ কখনোই দেওয়া হবে না এবং সেটা কাদের স্বার্থে সে প্রশ্ন তোলাটাই আসলে অবান্তর।

এই মুহূর্তে যে বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এরকম একটি অসম যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করে ও ক্ষমতার প্রয়োগে যেসকল রাজনৈতিক দলের জন্ম তারা যে রাজনীতি চর্চার পথ তৈরি করে গেছে সে পথ থেকে গণতান্ত্রিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষেও সে চর্চা থামানো সম্ভবপর হচ্ছে না কারণ এদেশে প্রবাদই রয়েছে যে, যে বাঘ একবার মনুষ্য রক্তের স্বাদ পায় তার আসলে অন্য কিছু আর রোচে না, তাকে বার বারই মানুষ হত্যা করতে হয়। রাজনৈতিক সরকারের নামে যদি প্রশাসন-বাহিনী-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের মেলবন্ধন তৈরি করে রাষ্ট্রকে লুটে খাওয়ার দরোজা একবার খুলে দেওয়া হয় তাহলে সবচেয়ে কঠোর শাসকের পক্ষেও সে দরোজা বন্ধ করাটা সহজ কাজ হওয়ার কথা নয়, কারণ যাদেরকে দিয়ে শাসক সেটা করতে যাবেন তারাই সেটার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।

আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শেখ হাসিনার সরকার দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথমেই একে প্রশংসা কিংবা স্বাগত জানানোর বদলে একদল বলছেন যে, এতোদিন পরে কেন শুরু করলেন? এর আগে কেন করলেন না? কিংবা শুধু ক্যাসিনো বন্ধ করলে হবে? বাকিদের কী হবে? এসব প্রশ্ন অবশ্যই তুলতে হবে কিন্তু তার সঙ্গে এই প্রশংসাটুকুও করা প্রয়োজন যে, এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক সরকার নিজ দলের ভেতর থেকেই শুদ্ধি অভিযানের শুরুটা অন্ততঃ করতে পেরেছে, এদেশে যার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। অরাজনৈতিক সরকার যে সকল অভিযোগ রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে এনে ক্ষমতা দখল করে প্রথমে কিছুদিন ধড়পাকড় চালিয়ে থাকে তারপর নিজেদের লোকেরা দেশটাকে লুটের ভাণ্ড মনে করতে থাকে সেই সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই শেখ হাসিনার সরকার যে পথে নেমেছে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে, যে চক্রটি (রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক) এতোদিন এই মৌরসিপাট্টার সুযোগ গ্রহণ করেছে তারা শেখ হাসিনার এই উদ্যোগকে কী ভাবে দেখছে?

প্রথমেই আসা যাক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কথায়। বলাই বাহুল্য যে, বাংলাদেশে রাজনীতিকে কলুষিত করার কাজটি সেনা শাসকগণ ও তাদের গঠিত রাজনৈতিক দলগুলিই মূলতঃ করেছে। পরবর্তীতে যখন আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে তাকেও দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে দলের ওপর নিয়ন্ত্রণকে ঢিলে করতে হয়েছে, নাহলে এদেশে আওয়ামী রাজনীতি টিকতো কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের কাছে তার যার দেশপ্রেমিক সমর্থকগোষ্ঠী তারা কেউই চায় না যে, এই দলটিও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ তৈরি করে দিক। কিন্তু সেটা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণেই যে হয়েছে তার প্রমাণ দলের নেতাদের কল্যাণেই এই দলের ভেতর এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে বহুদল থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণকারী (বিশেষ করে সেসব দল যখন ক্ষমতায় ছিল) রাজনৈতিক দুর্বৃত্তগোষ্ঠী। তারাই আজকে কখনও প্রশাসনকে হাত করে, কখনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তার সহযোগিতায় দেশের ভেতর এক ভয়ঙ্কর অপরাধের জাল বিস্তার করেছে এবং ব্যাপক অর্থবৃত্তের মালিক হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে হাওয়া ভবনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে যে বিশাল দুর্বৃত্তগোষ্ঠী রাষ্ট্রকে লুটপাট করেছে তাদের অনেকেই যে আওয়ামী লীগেও এসে আশ্রয় নিয়েছে তার প্রমাণ এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আর এ জন্য আর কেউ-ই নয়, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। যদিও সব দায় ও দোষের আঙুল শেখ হাসিনার দিকেই তোলা হচ্ছে ও হবে, তাই শেখ হাসিনাই সাহসী হয়ে এদেরকে উৎপাটনের কাজে নেমেছেন, এখন দেখা যাক তিনি কতোটা সফল হন এবার।

যে প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেই রাষ্ট্রের প্রশাসনের রাজনীতিকরণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার ইচ্ছে রইলো বারান্তরে। আজকে শুধু একথাটি বলেই শেষ করতে চাই যে, রাজনৈতিক সরকারগুলোকে চাইলেই প্রশাসন সম্পূর্ণ ভাবে ধসিয়ে দিতে পারে, যদি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত পদে যারা রয়েছেন তারা নিজেদের বিভিন্ন ভাবে দুর্বল করে ফেলেন। এদেশেও আমরা এমনটিই শুনে থাকি যে, প্রশাসন চাইলেই যে কোনো সময় সরকার ফেলে দিতে পারে কিংবা সরকার গড়তেও পারে। তার মানে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কখনও কখনও প্রশাসন চ্যালেঞ্জ জানায় বটে, এর বহুবিধ কারণ রয়েছে।

আজকে শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নরোধে প্রশাসনকে নিয়েই মাঠে নেমেছেন বলে প্রতীয়মান। এতে প্রশাসনকেও একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছে পরোক্ষভাবে যে, তারাও যেনো সাবধান হয়ে যান। এরই মধ্যে আমরা প্রশাসনের বেশ কয়েকটি ‘গ্রস’ দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে বলেই জানতে পেরেছি, হয়তো আরও অনেক কিছুই আমরা এখনও জানিনে। যেহেতু প্রশাসন রাজনৈতিক ভাবে নিয়োজিত নয় বরং কথিত ‘রাজনীতি-নিরপেক্ষ’ সেহেতু এসব দুর্নীতির দায়ও আসলে এসে পড়ছে রাজনৈতিক সরকারের গায়েই। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার সরকার শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেন সেটাও জনগণ দেখতে চায়। তিনি যদি এক্ষেত্রেও কঠোর হতে না পারেন তাহলে বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক সরকার সেটা পারবে না- এটাও একটি চরম ও তিক্ত সত্য।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা