• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

সমমর্যাদা প্রতিবন্ধীর মৌলিক অধিকার

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০১৯  

আমাদের ছেলেবেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্ণমালা শিখতে ‘বাল্যশিক্ষা’ পড়ানো হতো। তাতে পড়তাম ‘কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না, তাহাদের মনে কষ্ট পায়’, পড়তাম ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ ইত্যাদি। আমার যতদূর মনে আছে, শ্রেণিকক্ষে পণ্ডিত স্যার প্রথমে পড়তেন এবং তা শুনে আমরা সমস্বরে বলতাম। সে সময় এই বাক্যগুলো এমনভাবে শেখানো হতো, যেন সেই কচি বয়সের শিশুদের হৃদয় এবং মস্তিষ্কে তা গেঁথে থাকে। ফলে শিশুকাল থেকেই মানুষের মধ্যে যে মূল্যবোধের সৃষ্টি হতো, তা থেকে প্রতিবন্ধীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা পুণ্যময় কাজ মনে হতো। তাদের ছোট করে ভাবাকে মনে হতো পাপ। শুধু পাপই না, মহাপাপ। সেই বয়সে এটাও ভাবতে পারতাম—সৃষ্টিকর্তা যাদের সম্পূর্ণ করে পাঠিয়েছে, তারা যদি অসম্পূর্ণ মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে, তবে পরকালে নরকের আগুনে জ্বলতে হবে।
এখন আর সেই বাল্যশিক্ষাও নেই, নেই পণ্ডিত স্যার, নেই সেই পাপবোধ। সেটা থাক আর না থাক, তবে এটাই সত্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহমর্মিতাই মানুষের ধর্ম এবং সমমর্যাদা প্রতিবন্ধীদের মৌলিক অধিকার। সম্ভবত এই সত্যটাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা বছরের একটি দিনকে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সেই দিনটি হলো ৩ ডিসেম্বর। এই দিনটিকে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে ঘোষণার পেছনেও রয়েছে ঘটনাবহুল জীবনস্মৃতি। ১৯৫৮ সালে মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ নিহত হন এবং ৫ সহস্রাধিক মানুষ চিরজীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে অনেক সামাজিক সংস্থা এগিয়ে আসে। তাদের জন্য ১৯৫৯ সালে জুরিখে বিশ্বের বহু সংগঠন সম্মিলিতভাবে একটি সম্মেলন করে। সে সম্মিলনে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বেশ কিছু প্রস্তাব ও কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং বছরের একটি দিনে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়। পরে ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘ ৩ ডিসেম্বরকে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস ঘোষণা করে এবং যথারীতি তা পালিত হয়। 

এককথায় প্রতিবন্ধী সম্পর্কে বললে বলতে হয় মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে মানুষটির মধ্যে রয়েছে, সেই প্রতিবন্ধী। অন্ধ বোবা বধিরকে যেমন শারীরিক প্রতিবন্ধী বলি, তেমনি মানসিক ভারসাম্যহীন বোকা উন্মাদকে বলি মানসিক প্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধীরা শারীরিক-মানসিক কিংবা আর্থসামাজিক অক্ষমতার কারণে স্বাভাবিক ও স্বাবলম্বী জীবন-যাপন করতে পারে না। তুলনামূলকভাবে তাদের দুঃখ-দুর্দশা সীমাহীন, যা হওয়ার কথা ছিল না। স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে অন্যসব স্বাভাবিক মানুষের মতো প্রতিবন্ধীরাও সমান অধিকার নিয়ে জন্মেছে এবং সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব বর্তায় যারা প্রতিবন্ধী নয় সেইসব মানুষের ওপর। কারণ মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টিই করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। অতএব জন্মগতভাবেই প্রতিবন্ধীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব অনেক। শিক্ষা প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যসেবা পুনর্বাসন কর্মসংস্থান ও বিনোদন লাভ আমাদের মতো প্রতিবন্ধীদেরও মৌলিক অধিকার। পরমুখাপেক্ষিতার পথ থেকে স্বাবলম্বীতার পথে আনা এবং সমাজের আর দশজনের মতো তাদের হাতকেও কর্মীর হাতে পরিণত করার পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। কিন্তু সমাজে যা দেখা যায় তা হলো, দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধীরা ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। মধ্যবিত্ত ও ধনাঢ্য পরিবারে প্রতিবন্ধী সদস্যের কথা উল্লেখ করতে তারা অপমানবোধ করে। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে তাদের বিরত রাখা হয়। সমাজ বৈষম্যের শেকলে বাঁধা পড়ে তারা। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এমন প্রতিবন্ধীর অভাব নেই যারা আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে বিভিন্নভাবে সমাজে অবদান রাখছেন। কেউ শিক্ষকতা করছেন, ব্যবসা করছেন, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প পরিচালনা করছেন, কৃষিকাজসহ নানা কাজ করছেন। 

প্রতিবন্ধীর প্রতিভা ও সক্ষমতা নিয়ে একটি জাপানি গল্প আছে। দুর্ঘটনায় বাঁহাত হারানো এক জাপানি প্রতিবন্ধী ছেলের জুডো শেখার দুর্দান্ত ইচ্ছে ছিল।  গুরু তাকে দীর্ঘদিন ধরে জুডোর একটিমাত্র প্যাঁচ বা কৌশলই শিখালেন। দীর্ঘ অনুশীলনে এই প্যাঁচ বা কৌশলের সবকিছু দারুণভাবে রপ্ত হয়ে গেলো তার। প্রতিযোগিতার ম্যাচে শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষের হাতে প্রতিবন্ধী ছেলেটি এমন মার খাচ্ছিল যে একপর্যায়ে রেফারি খেলা বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু ছেলেটি নাছোড়বান্দা। খেলা চালিয়েই যেতে হলো। মার খেতে খেতে একসময় তার শেখা সেই একমাত্র প্যাঁচ বা কৌশল প্রয়োগের সময় এলেই সে সেটি প্রয়োগ করলো, আর তখনই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ধরাশায়ী হয়ে পড়ল। কারণ প্রতিবন্ধী এই ছেলেটি জানতো ওই কৌশলটি ব্যবহার করলে প্রতিপক্ষকে বাঁচার জন্য তার বাম হাত ধরতে হবে, কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলেটির বাম হাত-ই নেই, অতএব প্রতিপক্ষের রক্ষা পাওয়ার আর কোনও উপায় অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং বিজয় সুনিশ্চিত।  

গল্পটি এখানে উদ্ধৃত করলাম এ কারণেই, প্রতিবন্ধী শব্দটি শুনলেই মনে হয় এরা আমাদের বোঝা। আসলে কি তাই?  না তা নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে স্রষ্টা প্রদত্ত তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন অনন্য প্রতিভা। অনেক অনেক ক্ষেত্রে সাধারণের প্রতিভার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। তাদের এই মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলেই তারাও মানবসম্পদ। উপযুক্ত পরিচর্যা অনুকূল পরিবেশ আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারাও দেশ ও জাতি গঠনে যোগ্য অংশীদার হতে পারে। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ বিশেষ কোনও না কোনও গুণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আজকে যাকে আমরা প্রতিবন্ধী বলছি, তিনি তার সেই গুণকে ব্যবহার করার সুযোগ পেলে কালকে হবেন অনন্য। অন্যের বোঝা হয়ে থাকবেন না কখনোই। আমাদের প্রয়োজন শুধু তার জন্য সেই পথটি সৃষ্টি করে দেওয়া।

ধর্মীয়ভাবেও প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে উপহাস করা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) একজন প্রতিবন্ধীকে মদিনার শাসনকর্তা নিযুক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধীর সমমর্যাদা অধিকারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন।

একথা অনস্বীকার্য, একটি দেশের অবকাঠামো ভালো হলেই সেদেশের প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত সম্ভব হয়। সম্ভবত একারণেই উন্নত বিশ্বে প্রতিবন্ধীদের অধিকার যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমাদের দেশে এখনও তা হয়নি। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যসেবা পুনর্বাসনের ওপর আমাদের আরও যত্নশীল হতে হবে। উন্নত চিকিৎসার সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা দূর করার কাজে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এতে দৃষ্টিশক্তি শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়াসহ জটিল মানসিক প্রতিবন্ধী সুস্থ হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারবে। সবার আগে প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রকাশের মানসিকতা সৃষ্টি হওয়া। তবেই তাদের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করা, দেশ ও জাতি গঠনের যোগ্য অংশীদার করে তোলা সম্ভব হবে এবং একদিন প্রতিবন্ধীদের সমমর্যাদার মৌলিক অধিকার এ দেশেও প্রতিষ্ঠিত হবে।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা