• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নারদ নদ

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ৬ মার্চ ২০১৯  

জালের মতো বিস্তার ছড়িয়ে দেশের দেহে প্রাণের সঞ্চার করে নদী। নদীপ্রবাহের তীরে গড়ে ওঠে সভ্যতা। বিলুপ্তও হয়। একসময় দেশের প্রায় সব কটি নদী প্রচণ্ড খরস্রোতা ছিল। নদীপ্রবাহে ছিল না মানবসৃষ্ট কোনো প্রতিবন্ধকতা। প্রকৃতির নিয়মে নদীগুলো বয়ে চলত আপন স্বভাবে। তেমনই এক নদী নাটোরের নারদ নদ। একসময় এই নদও ছিল খরস্রোতা। মানুষের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতায় খরস্রোতা নদটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য, দখল, ভরাটের কারণে নারদ নদ বর্তমানে পরিণত হয়েছে সরু খালে।

অন্যদিকে নদটি খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। খননের মাটি ফেলে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহু অবৈধ স্থাপনা। কলকারখানার দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নদের পারের মানুষদের জীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় নদ সংস্কার, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং দূষিত বর্জ্য ফেলা বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে নাটোরবাসী।

নাটোরের নারদ নদ এখন দখল আর দূষণে বিলুপ্ত হতে চলেছে। নাটোরের প্রাণ হিসেবে পরিচিত এ নদটি অপরিকল্পিতভাবে খনন করে দীর্ঘ সরু একটি নালায় পরিণত করা হয়েছে। খননের কাটা মাটি নদতীরে ফেলায় অবৈধ দখলদাররা ইচ্ছেমতো গড়ে তুলেছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। অন্যদিকে নাটোরের বড় বড় কয়েকটি শিল্প কারখানার দূষিত বর্জ্যরে দুর্গন্ধে নদপাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এছাড়া চারঘাট স্লুইসগেট দিয়ে পানি প্রবেশ করতে না পারায় নারদ নদ এখন একটি মরা খালে পরিণত হতে চলেছে। এখন নদটির অবৈধ সব দখল উচ্ছেদ করে সংস্কারের দাবি নাটোরবাসীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

 

নাটোরের প্রবীণ লোকজন জানান, নারদ নদকে ঘিরে প্রায় তিনশ বছর আগে নাটোর শহরের গোড়াপত্তন হলে মানুষের মাঝে সে সময় প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হয়। বিগত ১৭০৬ সালে নাটোরের রাজা রামজীবন ও রঘুনাথ এখানেই তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলার তখনকার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গেও গড়ে ওঠে নাটোরের যোগাযোগ। সে সময় খরস্রোতা এ নারদ নদই ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল। এতে এ নদের  দুই ধারে গড়ে ওঠে নগর, গ্রাম, গঞ্জ ও বসতি। নারদই ছিল নাটোরের প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। সেসময় নদের বুকে চলতো পাল তোলা নৌকা আর পণ্য বোঝাই স্টিমার। নদের স্বচ্ছ পানিতে প্রচুর মাছও পাওয়া যেত। নারদের স্বচ্ছ পানি ও নির্মল বাতাস সে সময়ে দুপাড়ের মানুষের স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের সন্ধান জুগিয়েছে।

নারদ নদ নিয়ে লেখা বইয়ের লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেছেন, ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, নারদ বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি নদ। নারদ নদের দুই তীরে অবস্থিত নাটোর শহর থেকে একসময় রাজশাহী অঞ্চলের শাসনকার্য নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৮২১ সালে পদ্মা নদীতে বন্যায় ব্যাপক জলস্ফীত হলে উৎসমুখে বালি ও পলি জমে নারদ স্রোতহীন হয়ে পড়ে। সেবারের বন্যায় দীর্ঘদিন নাটোর জলাবদ্ধ হয়ে থাকায় রাজশাহী অঞ্চলের সদর দফতর নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮২৫ সালে স্থানান্তর করা শেষ হয়। ১৮২১ সাল থেকেই নারদ নদের রাজশাহী অঞ্চলের প্রবাহটি মরা নদে পরিণত হতে শুরু করে। রাজশাহী জেলার চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদীর জন্ম হয় এবং বড়াল থেকে জন্ম হয় মুসাখাঁ নদীর। নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মুসাখাঁ নদী থেকে নারদ আবার পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে চারঘাটে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইসগেট তৈরি করার পর পরই নারদ মৃত নদে পরিণত হতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদতীর ভরাট করে শুরু হয় দখল প্রক্রিয়া। গড়ে তোলা হয় স্থায়ী ও অস্থায়ী বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। এতে কমতে থাকে নারদ নদের আয়তন। নাটোরের ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের স্রোতস্বীনি নারদ নদ অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, ১৯৬২ সালের ভূমি রেকর্ড অনুযায়ী নাটোর শহরের ভেতরে নারদের আয়তন ছিল প্রায় দুইশ একর এবং ১৯৭৪ সালের রেকর্ডে সেই আয়তন কমে দাঁড়ায় একশ দশমিক এক একরে। সরকারি হিসাবেই ওই ১২ বছরে এ নদের প্রায় একশ একর আয়তন কমে যায়। কাগজপত্রে জমির আকার পরিবর্তন করে নদের দু'পাড় বাধাহীনভাবে দখলের কারণেই আয়তন কমতে থাকে। ধীরে ধীরে দখলের কবলে পড়ে আরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে এ নদটি। নাটোরের ভারি সব কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে নদের পানি বিষাক্ত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নারদ নদের পাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ছড়াতে শুরু করেছে নানা ধরনের রোগব্যাধি। নারদ নদের দূষিত স্রোতহীন পানি মশা-মাছির উৎপাদন খামারে পরিণত হয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী নারদ নদের বর্জ্যে পিএইচপির পরিমাণ ৮ দশমিক ১৮, অয়েল অ্যান্ড গ্রিজ ১৭ মিলিগ্রাম পার লিটার, ভাসমান কঠিন পদার্থ ১১০ মিলিগ্রাম পার লিটার এবং বিওডি ৩৫ হাজার ৪০০ মিলিগ্রাম পার লিটারে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রা পিএইচপি ৬ থেকে ৯, অয়েল অ্যান্ড গ্রিজ ১০ মিলিগ্রাম পার লিটার এবং বিওডি ৫০ হাজার মিলিগ্রম পার লিটার। এতে নদ তীরের মানুষকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডির তথ্য মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন সদর উপজেলার হাশিমপুর, সাধুপাড়া, মোহনপুর, পীরগঞ্জ ও কসবা গ্রামে নারদের ওপর ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কালভার্ট রয়েছে। এখন ওইসব কোনো কালভার্ট দিয়েই আর পানি চলাচল করতে পারছে না। সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নের লোটাবাড়িয়া গ্রামে নারদের ওপর মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করেছেন স্থানীয় লোকজন। নারদে পানি ঢোকার পথে চারঘাটে স্লুইসগেটের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি প্রতিবন্ধক রয়েছে।

এগুলোর মধ্যে পকেটখালি এলাকায় এলজিইডির একটি ব্রিজ এবং পীরগাছা এলাকায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ক্রসওয়াল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আর এ দুটিই পড়েছে মুসাখাঁ নদীর ওপর। তবে মুসাখাঁর এ প্রবাহ ধরেই নারদে পানি আসে। পীরগাছার পর থেকে শুরু হয়েছে নারদের প্রবাহ এবং এখান থেকে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সরু ও উঁচু বেডের ১৪টি সেতু ও কালভার্ট। নদের পানি প্রবাহ সৃষ্টি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে দৈনন্দিন গৃহস্থালী ও কৃষি সেচে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬ কিলোমিটার খনন কাজের প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং জনগণের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত চারঘাট রেগুলেটরের ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়িয়া রেগুলেটর থেকে মুসা খাঁ নদীর পানি নারদ নদে প্রবাহিত করার প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মুছা খাঁ নদীর এক কিলোমিটারে পাউবোর ডিজাইন বেড থেকে ৪ মিটার উঁচু করে এলজিইডি সেতু নির্মাণ করে। এছাড়া পাইকপাড়ায় ৫ কিলোমিটারে নদীতে আর সিসি পাকা দেওয়াল নির্মাণ করায় নারদ নদে পানি ঢুকতে পারছে না। ফলে বাস্তবায়িত প্রকল্পের কোনো সুফল পাচ্ছে না জনগণ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশ কুমার জানান, নারদ নদ পুনঃখননের জন্য একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে নারদ নদে পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ  জানান, নাটোর পৌর এলাকার ছয় কিলোমিটারের মধ্যে অবৈধ দখলকারীদের তালিকা প্রস্তুত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক একটি তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা