• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

তালায় করোনার কারণে বিপাকে দুগ্ধ খামারীরা

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০২০  

করোনা ভাইরাসের কারণে দুধ বিক্রি না হওয়ায় সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দুগ্ধ খামারীরা বিপাকে পড়েছে। অত্র উপজেলায় প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও বিক্রি করতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকেই। প্রতিদিন খামারের দুধ বিক্রি করে চলতো প্রায় দুই হাজার মানুষের সংসার। কিন্তু খামারের এ দুধ বাইরে নিয়ে যেতে না পারায় অর্ধেক দামে এলাকায় বিক্রি করছেন তারা। মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে বিক্রি করতে হচ্ছে এক লিটার দুধ। অথচ বাইরে পাঠাতে পারলে এ দুধের দাম পেতো ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। এজন্য দুধ বিক্রি নিয়ে তেমন কর্মব্যস্ততাও নেই খামারীদের মাঝে।

তবে তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ সন্জয় বিশ্বাস বলেছেন, অত্র উপজেলায় উৎপাদিত তিনভাগের একভাগ দুধ অবিক্রিত হচ্ছে। এসব দুধ দিয়ে ঘি, ছানা, মাখন তৈরি করে তা বাজারজাত করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে খামারীদের।

তালার জেয়ালা ঘোষপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষ জানান, তাদের খামারসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। উৎপাদিত দুধ সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর জেলা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন কোম্পানীসহ দোকানে বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে কোন কোম্পানী বা দোকানীরা দুধ নিচ্ছে না। একদিন নিলেও চার দিন দুধ নেওয়া বন্ধ রাখছে। যেটা নিচ্ছে তার টাকাও বকেয়া পড়ে থাকছে। এ জন্য স্থানীয় বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারীরা।

খামারী বিপ্লব ঘোষ জানান, প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা, খুলনার ব্র্যাক আড়ং, আঠার মাইল, কাশিমনগর ও জাতপুর প্রাণসহ বিভিন্ন কারখানায় তারা খামারের দুধ বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন তারা নিয়মিত দুধ নিচ্ছে না। আর যা নিচ্ছে তার টাকাও বকেয়া পড়ে থাকছে।

আরেক খামারী জেয়ালা গ্রামের সুজন ঘোষ জানান, তিনি গ্রামে দুধ সংগ্রহ করেন। কিন্তু গত পাঁচ দিন দুধ বিক্রি করতে পারেনি। এ জন্য আজ সোমবার (১৩ এপ্রিল) সবাইকে দুধ নিবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। করোনার প্রভাব না গেলে তিনি আর দুধ সংগ্রহ করবেন না।

তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে (তালা ও ডুমুরিয়া) সীমানায় জেয়ালা গ্রাম। এ গ্রামের ঘোষপাড়ায় ১৫০টি পরিবারের প্রায় এক হাজার লোকের বসবাস। এ পাড়ায় মানুষের প্রধান কাজ কৃষি ও গাভী পালন। এখানে রয়েছে ছোট বড় ১৩৭টি দুগ্ধ খামার। এ দুগ্ধ খামারের আয়ে চলে তাদের সংসার।

সোমবার সকালে জেয়ালা ঘোষ পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, খামারে বাঁধা আছে ছোট বড় দেশি-বিদেশি গাভী। কেউ দুধ সংগ্রহ করছেন। কেউ খাবার দিচ্ছেন। কেউ ভাল পাত্রে দুধ রাখার চেষ্টা করছেন। কিভাবে কোথায় বিক্রি করা যায়, তা নিয়ে আালাপ করছেন তারা। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে কেউ বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। সকলে বাড়িতে আছেন। প্রশাসনের ভয়ে দুএকজন বাইরে গেলেও যাচ্ছেন গোপনে।

এসব খামারে জার্সি, ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, হরেষ্টইানসহ বিভিন্ন জাতের গরু রয়েছে। এরমধ্যে জার্সি, ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল গরুর সংখ্যা বেশি। এখানে যত গরীব পরিবারই থাকুক না কেনো, তাদের কমপক্ষে ৫টি গরু রয়েছে। আর যাদের অবস্থা মুটামুটি ভালো তাদের ৫ থেকে ৫০ টি করে গরু আছে।

এসব দুগ্ধ খামারীদের ভাষ্যমতে,‘দুধ তো আর নষ্ট করা যাবে না। যে ভাবে হোক কম দামে হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে। দুধ নেওয়ার কোম্পানীগুলো দুধ নিচ্ছে না। দুধ নিলেও টাকা দিচ্ছে না। কিভাবে চলবে তাদের খামার। চলবে সংসার।’

খামারী বিপ্লব ঘোষ জানান, তার খামারে সাতটি গাভী রয়েছে। প্রতিদিন একটি গরুর পেছনে তার ২৫০ টাকার মতো খরচ হয়। দুধ বিক্রি করে তার খরচের টাকা উঠতো। বর্তমানে দুধ বিক্রি না হওয়ায় খরচের টাকা উঠছে না। এতে তিনি বিপাকে পড়েছে।

দুধ বহনকারী চালক জুয়েল গাজী জানান, দুধ বহন করে তার সংসার চলতো। কিন্তু করোনার প্রভাবে কেউ সড়কে উঠতে দিচ্ছে না। দুধ কোম্পানীগুলো দুধ তেমন নিচ্ছে না। এজন্য তিনি বাইরে যান না। বেকারত্ব সময় কাটছে বাড়িতে।

জেয়ালা ঘোষপাড়ার দিপংকর ঘোষ জানান, তার বাড়িতে ৯ টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন তার ২২ থেকে ২৫ কেজি দুধ উৎপাদন হচ্ছে। এ দুধ বিক্রির মধ্য দিয়ে চলতো তার সংসার। কিন্তু এ দুধ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে না। এমন বক্তব্য জেয়ালা দুগ্ধ পল্লীর অনেক খামারী।

পার্শ্ববর্তী আটারই গ্রামের আবু হারেজ সরদারের ছেলে আল-আমিন সরদারের খামারে বর্তমানে ৩০টি গাভি রয়েছে। এরমধ্যে ১০টি গাভি দৈনিক একশ’ লিটার দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। বাকি গাভিগুলোও পর্যায়ক্রমে দুধ দেবে। কিন্তু পানির দামে দুধ বিক্রি হওয়ায় দারুণ বিপাকে পড়েছেন তিনি।

জেয়ালা ঘোষপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি দিবস ঘোষ জানান, তার নিজেরও প্রতিদিন ২৮০ লিটারের মতো দুধ উৎপাদন হয়। বর্তমানে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে না। এতে করে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তার ভাষায়,‘খামারীরা এবার শেষ।’

তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ সন্জয় বিশ্বাস জানান, অত্র উপজেলায় প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও তিনভাগের একভাগ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এছাড়া দুগ্ধপল্লী জেয়ালা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে উৎপাদিত প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধের মধ্যে ৫ হাজার লিটার অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এসব দুধ দিয়ে ঘি, ছানা, মাখন তৈরি করে তা বাজারজাত করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে খামারীদের। তবে প্রাণ, ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্ক ভিটা প্রভৃতি কোম্পানি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া মিষ্টির দোকানগুলো দুধ সরবরাহ করলে এ সমস্যা অনেকটা কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, অত্র জেলা গরুর দুধে সমৃদ্ধ। জেলায় প্রতি বছর ১.৯০ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়। যারমধ্যে এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় তালা উপজেলায়। জেলায় ছোট বড় খামার রয়েছে ২ হাজার ৫০২টি। প্রথমদিকে খামারিদের দুধ অবিক্রিত থাকলেও বর্তমানে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। তবে দুধের সদ্ব্যবহার করতে খামারীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি ।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা