• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

ঢাকার বাতাসে বাড়ছে সিসা ও নিকেল

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২ মার্চ ২০১৯  

রাজধানীর বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কার্বন ও সিসার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঢাকার বায়ুমান সূচক ২৬৯ যা কিনা লাল ক্যাটাগরিতে রয়েছে। বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ রাজধানীর আশপাশে ইটভাটা। বাংলাদেশে বছরে বায়ুদূষণের কারণে লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। পাশাপাশি শ্বাসকষ্টজনিত নানা সমস্যায় ভোগে অনেকেই। পরিবেশ অধিদফতর আরো বলছে, সম্মিলিত উদ্যোগ আর আইন প্রয়োগ কঠোর না হলে বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে না।

ঢাকার বাতাস এখন লাল ক্যাটাগরিভুক্ত। ঢাকার তিনটি স্থানে পরিমাপক যন্ত্র বসিয়ে ঢাকার বায়ু মানের সূচক মিলেছে ২৬৯। চীন ও দিল্লির বায়ুমানের চেয়েও শোচনীয় এই ফলাফল। তার পরও নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দূষণ বেড়ে যায় আরো ৪ গুণ। নরওয়ে ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্সের মাধ্যমে করা জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় ১ হাজার ইটভাটা নভেম্বর থেকে চালু হয়। সেগুলো এই বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া রোড ও সয়েল ডাস্ট জন্য ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ রয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে ৭ লাখেরও অধিক মানুষ ভুগছে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায়। সর্বশেষ বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৮ প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ মানুষ।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ-এ গবেষণা দুটির ফল সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার পথের ধুলোয় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের অস্তিত্ব মিলেছে। মাটিতে যতটা ক্যাডমিয়াম থাকা স্বাভাবিক, ঢাকায় পদার্থটি পাওয়া গেছে এর চেয়ে ২০০ গুণ বেশি। ক্যাডমিয়ামকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে শনাক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। বিশেষ করে প্রোটেস্ট ও লাং ক্যান্সারের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। অস্টিওপরোসিস ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় এটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরো পাঁচটি বায়ুদূষণকারী উপাদানের সঙ্গে এটিকে নিষিদ্ধ করেছে। বাতাসে নির্ধারিত মাত্রায় বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এসব ধাতু নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

এমন তথ্য পাওয়া গেছে, একাধিক জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক এয়ার ভিজুয়ালের জরিপে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা এক নম্বরে। বায়ু শুদ্ধতার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার শহরগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ঢাকা। এ তালিকায় রয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লি আর পাকিস্তানের শহর লাহোর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, পরমাণু শক্তি কমিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে দুটি গবেষণা করেছে। এতে উঠে এসেছে ঢাকার বায়ু নিশ্বাসের মাধ্যমে কতটা দূষিত পদার্থ আমাদের রক্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলায় সিসা ও নিকেলের মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। হৃদরোগ, ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ভারি ধাতু সিসা। এটি মানবদেহের শ্বাস-প্রশ্বাসপ্রক্রিয়া অকার্যকর করতে পারে। প্রসূতির জন্যও হতে পারে বিপদের কারণ। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার সঙ্গে আমরা আগে থেকেই পরিচিত। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানিতে এর মিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যেসব এলাকায় পানিতে আর্সেনিকের মিশ্রণ বেশি; সেখানে রোগবালাইও বেশি। ঢাকার রাস্তায় ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারি ধাতু এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা মানুষের চুলের ২৫-১০০ ভাগের বেশি ছোট। এসব সূক্ষ্ম ধাতুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও পানীয়ের মাধ্যমে সহজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

ধুলায় ভারী ধাতুতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিষয়ক গবেষণায় বলা হয়। রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাথ, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮টি এলাকার সবখানে ভারি ধাতু পাওয়া যায়। যেসব এলাকায় যানজট বেশি বা যানচলাচল বেশি সেখানে ভারি ধাতুর পরিমাণও বেশি। এর মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে, যেখানে ধাতু গলানো হয় সেখানেও। জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঢাকায় চলাচল করে। এসব যানবাহনে নিকেল ও ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি ব্যবহƒত হয়। ঢাকা মহানগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কলকারখানা। আবাসিক এলাকা আর কলকারখানা একই জায়গায় গড়ে উঠেছে। এসব কলকারখানার অনেকগুলোতে ক্যাডমিয়াম ব্যবহৃত হয়।

পরিবেশবিদ সুমন শামস বলেন, বাতাস ছাড়া বাঁচে না জীবন। কিন্তু রাজধানীতে এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি এখন নীরব ঘাতক। অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানা কারণে বিষাক্ত হচ্ছে বাতাস, বাড়ছে রোগ।

নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প পরিচালক মনজুরুল হান্নান খান বলেন, আইন প্রণয়ন করে যখন বাস্তবায়ন করতে যায় তখনই নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান রাস্তায় কাজ করছে এবং অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে তাদের মধ্যে একটি সমন্বয় দরকার।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল বলেন, প্রতিটি ডিপার্টমেন্টর সঙ্গে আমরা আর একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা শুরু করে দিয়েছি। দেশে সুরক্ষা ও উন্নয়নে আপনাদের আন্তরিকতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক সমিতির মহাসচিব মোতাহার হোসেন বলেন, পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বায়ু বা বাতাস। যা ছাড়া প্রাণিজগত এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। সে বাতাস আজ শুধু দূষিত নয়, জীবনহানির মতো ভয়াবহ কারণ। যেটি জীবন বাঁচায়, সেটি আজ জীবনহানির অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে। সেটা হয়েছে আর হচ্ছে আমাদের কারণেই। আমরাই এর জন্য শতভাগ দায়ী। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হলো নিউক্লীয় আবর্জনা, কয়লা পুড়িয়ে ধোঁয়া ও গন্ধ বাতাসে মিশে বাতাস দূষিত হচ্ছে।

পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দূষণের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হতে হচ্ছে, বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণা, ক্ষুদ্র বস্তুকণা দিন বাড়ছে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শহরের বাতাসে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি থাকে।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবুল্লাহ রাকসিন বলেন, ঢাকা শহরে শুধু গাড়ির ধোঁয়া থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার ৭০০ টন সূক্ষ্ম বন্তুকণা প্রতিনিয়ত বাতাসে ছড়াচ্ছে। বাতাসে এ সূক্ষ্মকণার মাত্রা বাড়ার ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের সর্দি, কাশি, হাঁপানি, এলার্জি এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বেড়ে যাওয়াতে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। বাতাসে ভাসতে থাকা সিসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

ঢাকা হাসপাতালের এক জরিপে উঠে এসেছে, যেসব শিশু বস্তিতে কিংবা রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠে তারা মাত্রাতিরিক্তভাবে সিসা দূষণের শিকার হয়। আর এই সিসা দূষণের কারণে শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভোগে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় প্রভাব গিয়ে পড়ে একজন গর্ভবতী মায়ের ওপর। দূষিত বায়ুর প্রভাবে তার গর্ভে থাকা শিশুটি আক্রান্ত হয়।

পরিবেশবিদ এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ বলেন, বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত সীসার অবস্থান থাকে সেটা একজন গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভের সন্তানকে মারাত্মকভাবে সারাজীবনের জন্য আক্রান্ত করে। কোনো গর্ভবতী নারী যদি দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের শিকার হন, তাহলে ক্রমাগত তারা অক্সিজেনের ঘাটতিতে থাকবেন, তারা সিওপিডিতে (ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) আক্রান্ত রোগী হবেন। আর এর ফলে তার গর্ভে থাকা সন্তানটি অপরিণত নবজাতক হিসেবে জন্ম নেবে। 

বায়ুদূষণ আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে খুব দ্রুত যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করা যায় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। এই কাজে সফল না হলে ২০৫০ সালে গোটা বিশ্বে বায়ুদূষণের ফলে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল আহমেদ জানান, ঢাকায় যে পরিমাণে কালো ধোঁয়া, ক্যামিক্যাল কারখানা বাতাস বিষাক্ত হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আমাদের বাসযোগ্য এই প্রিয় শহরটিকে পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলতে পারিনি। আমরা পরিবেশকর্মী পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। সবার আগে এই শহরে বসবাসযোগ্য মানুষদের সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশে লাং ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ডা. সাইফুদ্দিন বেননূর বলেন, বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়।

তিনি আরো বলেন, ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে তারা কত ভয়ঙ্কর বায়ুদূষণের শহরে বাস করে। অন্যান্য দেশের পরিবেশ ও আবহাওয়া বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারণ চালানো হয়। আমাদের দেশে এসবের কিছুই না হওয়ায় শহরবাসী থাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে।

চিকিৎসাবিদ ডা. এ কে এম মোশারফ হোসেন বলেন, বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকলে বিদেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে সরকারি কোনো সংস্থা তেমন কাজই করে না। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ চাইলে আবহাওয়া ও পরিবেশ অধিদফতরের মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা জনগণকে অবহিত করতে পারে।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা