• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

করোনা মহামারি ও পূর্ববর্তী জাতি সভ্যতার ধ্বংসের কারণ

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল ২০২০  

করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীতে এক মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। ছোট ও বড়র কোনো ব্যবধান নেই, কাছে ও দূরের কোনো পার্থক্য নেই। মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, সব সমাজে। কিছু কিছু এলাকায় এই মহামারি প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়েছে বহু শহর ও দেশ। কারো কারো মনে এ প্রশ্নও দোল খাচ্ছে, এটাই কি মানবসভ্যতা ধ্বংসের সূচনা? এটাই কি মহাপ্রলয়ের প্রারম্ভিকতা? এ মহাবিপর্যয়ে সৃষ্টিকর্তার এমন কী প্রজ্ঞা ও কৌশল রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে আমি এ প্রবন্ধে প্রথম মানবসভ্যতা ধ্বংসের কারণগুলো পর্যালোচনা করব। হয়তো আমরা বাস্তবতা উপলব্ধি করে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করতে সক্ষম হব।

মানবসভ্যতার সূচনা হয় পৃথিবীতে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর আগমনের মাধ্যমে এবং এর প্রথম পর্বের শেষ দিকে নুহ (আ.)-এর আগমন ঘটে। তখন মহান স্রষ্টার একত্ববাদের বিশ্বাস এবং একক উপাসনা থেকে মানবসভ্যতা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর বুকে মানবজীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, তাদের জীবনধারার গতি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল, তারা আত্মশক্তি অর্জনের সঠিক পথ ও মহান স্রষ্টার পরিচয় ভুলে গিয়েছিল। তখন আল্লাহ নুহ (আ.)-কে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের বহুত্ববাদী বিশ্বাসের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেন। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক ছাড়া কেউ তাঁর ডাকে সাড়া দিল না। ফলে তাদের ধ্বংস ও বিনাশে আল্লাহর চূড়ান্ত রীতি আবর্তিত হলো। মহাপ্লাবনোত্তর সময়ে নুহ (আ.) ও তাঁর সীমিতসংখ্যক অনুসারী শান্তি ও কল্যাণের সভ্যতা বিনির্মাণ করেন।

 

জাতি  সভ্যতা ধ্বংসের কিছু কারণ

১. আল্লাহকে অস্বীকার : নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহর একত্ববাদ ও রিসালাতের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল। আল্লাহ তাদের অস্বীকারের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, ‘তাঁর সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী নেতারা বললেন, আমরা তোমাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে করি না; আমরা দেখছি, তোমার অনুসরণ করছে তারাই যারা আমাদের মধ্যে বাহ্য দৃষ্টিতে অধম এবং আমরা আমাদের ওপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না, বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদী মনে করি। (সুরা : হুদ, আয়াত : ২৭)

২. আল্লাহর সঙ্গে শিরক : নুহ (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানান। তবু তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। কোরআনে সর্বশেষ অবস্থার বিবরণে এসেছে, ‘তোমরা কখনো তোমাদের দেব-দেবীদের ত্যাগ কোরো না;  পরিহার কোরো না ওয়াদ, সুয়াওআ, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নসরকে।’ (সুরা : নুহ, আয়াত : ২৩)

৩. অবিচার : মানবসভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলো জুলুম ও অত্যাচার। নির্যাতন মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসমতা তৈরি করে। মানুষের নিজ আত্মার সঙ্গে, আল্লাহর সঙ্গে ও অন্যদের সঙ্গেও সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। ফলে জগতের সর্বত্র বিশৃঙ্খল দেখা দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের শাস্তি! তিনি জনপদগুলোকে শাস্তি দান করেন যখন তারা অবিচার করে। নিশ্চয়ই তাঁর শাস্তি মর্মন্তুদ, কঠিন।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১০২)

৪. প্রেরিত পুরুষের আহ্বান প্রত্যাখ্যান : কোরআনের বহু আয়াতে রয়েছে, নবী-রাসুলদের মিথ্যাবাদী বলার কারণে পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘লোকেরা যদি আপনাকে অস্বীকার করে, তবে তাদের আগে অস্বীকার করেছিল নুহ, আদ ও সামুদের সম্প্রদায়, ইবরাহিম ও লুতের সম্প্রদায় এবং মাদায়েনবাসী আর অস্বীকার করা হয়েছিল মুসাকেও।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪২-৪৪)

৫. ভোগবিলাসে মত্ত হওয়া : আল্লাহর শাস্তির শিকার হওয়ার অন্যতম কারণ অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য এবং ভোগবিলাসে মত্ত হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘সীমালঙ্ঘনকারীরা যাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পেত তারই অনুসরণ করত এবং তারা ছিল অপরাধী।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৬)

৬. দাম্ভিকতা : নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায় ধ্বংস হওয়ার আরেকটি কারণ দাম্ভিকতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) দাম্ভিক ব্যক্তির জন্য শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি যখনই তাদের আহ্বান করি, যাতে আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তারা কানে আঙুল দেয়, বস্ত্রাবৃত করে নিজেদের ও জিদ করতে থাকে এবং অতিশয় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে।’ (সুরা : নুহ, আয়াত : ৭)

৭. ষড়যন্ত্র : নুহ (আ.) অবিশ্বাসীদের বহু ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। তাঁর সম্প্রদায়ের নেতারা ষড়যন্ত্রের সব ধরনের পথ ও পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল মানুষকে একত্ববাদ ও আল্লাহর উপাসনা থেকে বিমুখ রাখতে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছিল।’ (সুরা : নুহ আয়াত : ২২)

৮. পাপকর্ম বৃদ্ধি :  প্রথম মানবসভ্যতা ধ্বংস ও বিনাশের বড় কারণ হলো পাপ ও অপরাধের ব্যাপকতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের অপরাধের জন্য তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদের দাখিল করা হয়েছিল আগুনে। অতঃপর তারা কাউকে আল্লাহর মোকাবেলায় সাহায্যকারী পায়নি।’ (সুরা : নুহ, আয়াত : ২৫)

৯. পরিবর্তনের রীতি : মানবসমাজে আল্লাহর পরিবর্তনের রীতি চলে আসছে। তিনি কোনো জাতি ধ্বংস করলে তাদের পরিবর্তে অন্য জাতি সৃষ্টি করেন। যাতে তারা আল্লাহর জমিনে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যেমনিভাবে বহু সভ্যতার উত্থান-পতন হয়েছে, তেমনি বহু সভ্যতার সংস্কার, পুনর্গঠন ও পরিবর্তন ঘটেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা বিমুখ হও, তবে তিনি অন্য জাতিকে স্থলাবর্তী করবেন—তারা তোমাদের মতো হবে না।’ (সুরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ৩৮)

১০. আল্লাহর সিদ্ধান্ত : আল্লাহ যেভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জীবনকাল নির্দিষ্ট করেছেন, তেমনি তিনি প্রত্যেক জাতি ও সভ্যতার জন্যও সময়কাল নির্ধারণ করেছেন। সে কালের সমাপ্তি হলে সভ্যতারও পতন ঘটে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি যে জনপদ ধ্বংস করেছি তার জন্য নির্ধারিত ছিল একটি লিপিবদ্ধ কাল। কোনো জাতি তার নির্ধারিত কাল ত্বরান্বিত করতে পারে না, বিলম্বিত করতে পারে না।’ (সুরা  : হিজর, আয়াত : ৪-৫)

আল্লাহর রীতি সুনির্দিষ্ট পথে ধীরে ধীরে নির্ধারিত সময়ের দিকে এগিয়ে যায়। পরিশেষে যখন কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকে না, তখন জাতি ধ্বংসের নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে যায় এবং গন্তব্যস্থলে এসে থমকে যায়। যে জাতিই জীবনস্রষ্টা সম্পর্কে অবগত হয়েছে এবং সত্য থেকে পিছু হটেছে, আল্লাহ তাদের ধ্বংস করেছেন বা শাস্তি দিয়েছেন। অপরাধীদের জন্য আল্লাহর শাস্তি পূর্বনির্ধারিত তাঁর এই রীতি অনুসারে—‘প্রত্যেক জাতির জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে।’ আল্লাহর জ্ঞানের কোনো পরিবর্তন নেই। তাঁর রীতির কোনো বিকৃতি নেই। তা অবশ্যই ঘটবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে তাঁর ইচ্ছা, মর্জি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী। মানব ইতিহাসে উপযুক্ত কারণেই বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়েছে। আল্লাহর এই শাস্তি প্রদান সব মানুষকে আহ্বান করে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, রক্তপাত, অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্মসাৎ, অশ্লীল কর্ম এবং পাপ কাজ পরিহার করতে।

সুতরাং মানুষকে সর্বক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরতে হবে। জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। অশ্লীলতা ও পাপ কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। আর ইহকাল ও পরকালের মুক্তির জন্য উপায়-উপকরণ গ্রহণ করতে হবে। এগুলোই ব্যক্তি ও সমাজের সমৃদ্ধির কারণ। হে আল্লাহ! আপনি এই মহামারি ও বিপদাপদ তুলে নিন। আমাদের আপনার অভিমুখী করুন এবং আপনার সন্তুষ্টি কামনায় আদম সন্তানদের হাত উত্তোলিত করুন। হে আল্লাহ! কবুল করুন। আমিন! (সংক্ষেপিত)

ভাষান্তর : সাইফ মুরতাফি

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা