• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

শুভ জন্মদিন সবার প্রেরণা শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১  

১৯৫২ সাল।  ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ।  ছয় বছরের একটি শিশুর বাবা জেলখানায় অসুস্থ। দাদু ভাইয়ের সিদ্ধান্তে তিন মাল্লার নৌকা দিয়ে, দাদা-দাদী এবং মায়ের সাথে গোপলগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় পৌঁছান। ঢাকা পৌঁছাতে লেগে যায় চার-চারটে দিন। কৈশোরে তাঁর  ঘরের নাম ছিল ‘আলসে খানা’। যে ঘরটি গুছিয়ে রাখতেন মা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে কোন পোশাক পরে যাবেন ঠিক করে রাখতেন মা। তাঁর একমাত্র কাজই ছিল লেখাপড়া এবং গান শোনা। সন্ধ্যাবেলা এসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। গ্রামের বাড়ি গেলে সব বোনদের  নিয়ে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা ছিল তাঁর শখ। শখের খেলনাগুলো ১৯৫৮ সালের মাশার্ল ল’-তে ভেঙে চুরমার হয়েছিল, সাথে ভেঙেছিল তাঁর শিশুমন। তিন দিনের নোটিশে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে মায়ের সাথে  রাস্তার মধ্যে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি যখন ছেলে মেয়ের মা, তখনও তাঁর বাবা ভাত মেখে দিলে ভাত খেতেন। বাবা একটি ফ্রিজ এনেছিলেন সেই ফ্রিজটি টাকার অভাবে মা  বিক্রি করে দেন। মা চাল ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করতেন। মা সেই খাবারের নাম দিয়েছিলেন ‘গরিব খিচুড়ি’।

নানা ভাঙা-গড়ায় ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৬ নম্বরের তিন কামরার বাড়িতে ওঠেন। শ্রমিকের  টাকা বাঁচানোর জন্য মা তাদের নিয়ে দেয়ালে পানি দিতেন, ইট বিছাতেন। বাবা জেলে থাকতেন বলে ঈদের সময় কাপড়-চোপড় নতুন তেমন কিছু আসতো না। তাই মা সেলাই করতেন। একসময় তিনি কাপড় সেলাই শুরু করলেন। তাদের বাসায় ছিল সেলাই মেশিন। নিজের বাড়ির সদস্যদের কাপড় এবং পড়শিদের কাপড়ও বানিয়ে দিতেন। প্রতি রবিবার ফুফাতো ভাইবোনদের আগমনে বাড়িটি ছিল আনন্দবাড়ি। 

বাড়িটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আসা-যাওয়া ছিল ভীষণ। বাড়ির দোতলার সিঁড়িতে বসে বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। বাড়ির দোতলার সিড়িতে ফুফাতো বোনের সঙ্গে বসে চা পান করতেন  আর  গল্প করতেন।

বাসায় প্রচুর ভীড় হতো বলে তিনি এবং তার খালাতো বোন ছাদের ওপর বসে পড়তেন। অনেক সময় পানির টাংকির ওপর পা ঝুলিয়ে গলা ছেড়ে জোরে জোরে পড়তেন। তিনি ঘুম তাড়ানোর জন্যেও জোরে পড়তেন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা  আন্দোলনের সময় তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। বাসা ভর্তি মানুষ। পড়তে বসলেও মন পড়ে থাকতো মিটিংয়ে।

জানালার পাশে বসে সভা শুনতেন। সবাইকে চা বানিয়ে দিতেন। পাঁচ ভাই বোনের সবচেয়ে বড় সন্তান ছিলেন তিনি।

১৯৪৭ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর  গোপালগঞ্জ জেলার বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এই মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকায় জন্মের সময় বাবা ছিলেন না পাশে। এই মানুষটির নাম শেখ হাসিনা। 

১৯৫৪ সালে রাজধানী ঢাকার রজনীবোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।  ১৯৫৬ সালে টিকাটুলি নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে তাঁর হাতে খড়ি। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালে  গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ ( বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ)  থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তাঁর পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মা সর্বংসহা নারী এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। রাজনীতি সচেতন পরিবারে নিজের শৈশব-কৈশোর এবং বাবার বারংবার জেলখানায় বন্দীদশা শিশুমনে বিস্তার লাভ করায় বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে তাঁর নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬-১৯৬৭ শিক্ষাবর্ষে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে ভোটের মাধ্যমে সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৬৯ এ গণ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এর মাঝখানে ঘটে যায় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়- বাবা তখন জেলে অন্তরীণ। বিয়ের প্রস্তাব আসে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থী এবং ফজলুল হক হলের সহ সভাপতি মেধাবী ছাত্র পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। বাবা মায়ের সম্মতিতে ১৭ নভেম্বর পবিত্র শবই বরাতের রাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বাবা তার মেয়ের জামাইকে জেল গেটে একটি রোলেক্স ঘড়ি উপহার দেন। যা আজীবন সযতনে ছিল পরমাণু বিজ্ঞানীর কাছে। 

শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।  তিনি ১৯৭১ সালে ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ড. ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে পুত্র সন্তানের মা হন। সন্তান জন্মের সময় মা গৃহবন্দী আর বাবা জেলখানায় অন্তরীণ। পাশে ছিলেন  ছোট ফুফু খাদিজা হোসেন।  দ্বিতীয় সন্তান সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের মা হন ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর। ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে স্বামীর সাথে পশ্চিম জার্মানি যান। যেদিন চলে যাচ্ছিলেন, সেদিন তাঁর মা ভীষণ কেঁদেছিলেন। বড় সন্তানকে চোখের আড়াল করতে হবে এই বেদনায়। বিদেশে যাওয়ার পূর্বে দুই ভাইয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে তাদের বাড়িটি ছিল একটি উৎসবের বাড়ি।

জার্মানিতে একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ইং। হাসি-আনন্দে ছিল সেই অনুষ্ঠান। কে জানত সেই রাতই শেষ আনন্দের রাত। যে রাতে সব হাসি-কান্নার নোনাজল হয়ে পদ্মা, গঙ্গা এবং মধুমতীর মোহনায় এসে জড়ো হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি হয়ে যান এতিম এবং ভাই হারা বোন। মাত্র ২৮ বছর তখন তাঁর। যে বয়সে নিজের জীবনের সকল আনন্দকে একটি মানচিত্রে করে শান্তির পায়রার মতো উড়ার কথা। সেই জীবনটা হয়ে গেলো দুঃসহ এক জীবন। এমন একটি পরিস্থিতি হয়ে গেলো যে, কাছের মানুষগুলোও দূরে চলে যান। জার্মানি থেকে তিনি যুক্তরাজ্য এবং দিল্লিতে ছয় বছর নিবার্সিত জীবন কাটান। দিল্লিতে দুই বোন ছদ্মনামে থাকতেন। এক সময় শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়।

দুই সন্তানকে নিয়ে শেখ হাসিনা হয়ে যান একা। এই নির্বাসিত জীবনে ১৯৭৮ সালে  দিল্লিতে ছুটে গিয়েছিলেন খান সাহেব ওসমান আলী এম এল এ’র ছেলে  এবং তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ. কে এম শামসুজ্জোহা এবং তার পরিবার। সেদিন তিনি ছিলেন বিমর্ষ এবং তাদের পেয়ে শুধুই কেদেঁছিলেন। ১৯৮১ সালে ৯ এপ্রিল দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে যান শেখ হাসিনা। সেখানে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি কাগজ তাকে দেখান যেখানে তারিখ উল্লেখ করা  ৯ এপ্রিল, ১৯৪৬।

বাবার হাতের স্বাক্ষর দেখে শেখ হাসিনা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি দেশে ফিরবেন।  ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে আসেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্যদিকে বাবার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি মিলেনি। স্মৃতি  ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাননি। রাস্তার পাশে বসেই মিলাদ পড়ান। পরবর্তীকালে ১২ জুন ১৯৮১ সালে  বাড়িতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। শত শত স্মৃতিমাখা, ধুলোবালি, ময়লা নিজ হাতে পরিষ্কার করেন আর চোখের জলে বুক ভাসান। একদিকে দুই সন্তান অন্যদিকে দেশ। এদিকে বোন শেখ রেহানা দেশে এসে দেখেন বড় বোন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। বাচ্চা দুটোকে সময় দেবার মতো সময়ই তিনি করতে পারেন না। তখন তিনি শেখ হাসিনার দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেদিন মা শেখ হাসিনা গৃহবন্দী। দূর থেকে একটি গাছের কাছে দাঁড়িয়ে অঝোরে কান্নার স্মৃতি ভুলতে পারেন না ছোট বোন শেখ রেহানা।

দিনে দিনে তিনি হয়ে যান নিজ বৈশিষ্ট্যে একজন আপসহীন নেত্রী এবং একজন শক্তিমান লেখক। অকপটে  নিজের কথা, দেশের কথা লিখতে থাকেন। সেই সাথে ছুটে বেড়ান গণ মানুষের কাছে।

প্রিয় বই ‘পথের পাঁচালী’ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা  মুখস্থ করা মানুষটি হয়ে যান পুরোদস্তুর একজন লেখক। তবে তাঁর লেখনী শক্তিশালী হবার একটি কারণ ছিল। কারণ তাদের বাড়িতে বই পড়ার একটি পরিবেশ ছিল।  তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু  অবসরে বই পড়তেন এবং মা  বঙ্গমাতা বই পড়তেন। মায়ের সাথে বই কিনতে নিউমার্কেট যেতেন।  তাঁর শাড়ি গহনার শখ ছিল না। শখ ছিল বইপড়া। তাঁর বেশকিছু  বই সেই ভয়াল রাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এখনও তিনি কষ্ট পান। প্রায় ৪০ এর কাছাকাছি গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ করেছেন বাবার লেখা গ্রন্থ। এছাড়াও সিক্রেট ডকুমেন্টস প্রকাশ করে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন সত্যিকারের ইতিহাস।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ৩৫ এর কাছাকাছি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সন্তানের নামের  পাশে পিতার পাশাপাশি মায়ের নাম জুড়িয়ে দেবার উদ্যোগ তারই। বছরের প্রথম দিন সকল শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ তারই। সারাদেশে ৫৬০ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ তারই। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুকে দেশবাসীর কাছে উপহার দেওয়ার উদ্যোগ তারই। তাছাড়াও সমুদ্র জয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কেন্দ্র স্থাপন, প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো তারই উদ্যোগ। এমন আরও শত শত নব উদ্যোগের উদাহরণ দেওয়া যাবে। যা এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা দুঃসাধ্য। তাঁর এসকল উদ্ভাবনী  কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নিউজ উইকের মতে, তিনি বিশ্বের ১০ জন ক্ষমতাধর ব্যক্তির অন্যতম এবং পিপলস অ্যান্ড পলিটিকসের নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বিশ্বের সৎ সরকার প্রধানের তালিকায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী বিশেষজ্ঞ কমলা ভাসিন তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘যেহেতু সামাজিক লিঙ্গ আমাদের সকলের তৈরি। আমরা ছেলে ও মেয়ের, নারী ও পুরুষের একটি নতুন সংজ্ঞা দিতে পারি। আমরা যদি চাই তবে তা পরিবর্তন করতে পারি। আমরা এমন এক সমাজ তৈরি করতে পারি যেখানে মেয়ে মানেই অসহায় দুর্বল নয়, আর ছেলে মানেই কঠোর, উদ্ধত আদেশকারী ও নির্যাতন কারী নয়।’

হ্যাঁ, শেখ হাসিনা প্রমাণ করে দিয়েছেন, মেয়ে মানেই অসহায় দুর্বল নয়। টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে ওঠা হিজল গাছ থেকে খালে ঝাপিয়ে পড়া মেয়েটি একদিন উন্নয়নের রোল মডেল হবে কে জানত। তাঁর প্রজ্ঞা, সততা, অধ্যবসায় তাকে ক্ষমতায়িত করেছে। তাকে কেউ ক্ষমতায়িত করেনি। একজন নারী  সারাটা জীবন ব্যথা বেদনার মধ্যে দিয়ে যায়। সেই ব্যথা বেদনাকে জয় করে লৌহ মানবী হয়েছেন তিনি। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সর্বোপরি তিনি একজন নারী। তিনিও এই ব্যস্ততার মাঝে সন্তানের জন্মদিনে পোলাও রান্না করেন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে  গ্রামের মেঠোপথে ভ্যানে চড়েন, অবসরে নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেন। সকাল শুরু করেন তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন।

আট দশজন নারীর মতো তারও ইচ্ছে হয় রিকশায় চড়ার, সমুদ্রের জলে পা ভিজানোর, বোনের সাথে বরফ নিয়ে খুনসুটি করতে এবং বোনের সাথে ছবি তুলতে। যে মানুষটি তার সব হারিয়ে দিনভর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। তাঁর হৃদয়ের কান্না আমরা কয়জনে জানি। তিনি ছায়ানটে বেহালা শিখেছিলেন, ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। জীবন যুদ্ধের কঠিন সময়ে সব ভুলে গিয়ে স্মৃতির অ্যালবামে হাতড়ে বেড়ান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রহমান স্মৃতি জাদুঘরে।

তাদের আনন্দ বাড়িটি ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। তিনি ভীষণ বন্ধুবৎসল। এক যুগ পরেও বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তিনি দিব্যি তাদের নাম ধরে ডাকেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট উপহার পেলে যারপরনাই খুশি হন। গণমাধ্যমে  রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে পেয়ে সরাসরি শিল্পীকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান। খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেবার জন্য মাঠে খেলা উপভোগ করতে চলে যান।  তিনি আপাদমস্তক একজন মানবিক এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন ব্যক্তিত্ব। তাইতো শিক্ষককে লাল গালিচা ছেড়ে দেন এবং শিক্ষকের গায়ের চাদর ঠিক করে দেন। মঞ্চ  থেকে শিক্ষককে সালাম দেন। বাংলাদেশে মাদার তেরেসা এলে ছুটে যান তাঁর কাছে। কাউকে কোনও কিছু না বলে ১৯৯৮ সালের ২৪ মার্চ ছুটে যান কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে। 

২০১০ সালে ৩ জুলাই ঢাকার নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে গণভবনে মা বাবা হারানো তিন নারীকে বিয়ে দিয়ে তাদের মায়ের ভূমিকা পালন করেন।  মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেন। বন্ধুদের ভাষায়, তিনি একজন অমায়িক, প্রাণোচ্ছল এবং নিরহংকার একজন মানুষ।

আমার দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা একজন নারী নয়, তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। বলা হয়, পুত্র বংশের বাতি। তাহলে শেখ হাসিনা একজন নারী হয়ে পুরো দেশে যে উন্নয়নের বাতি জ্বালিয়েছেন তাহলে তিনি এক কথায় বাংলাদেশের বাতি। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলেন, ‘বাস্তবিক অলংকার দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্য বর্ধনের উপায় মনে করা যায়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়! সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টা ও কি কম দুর্বলতা নয়’?

এই বাংলাদেশে একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলে  একজন শেখ হাসিনার জন্ম হয়েছে। ২৩ বার মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা এই মানুষটির ৭৫ তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা কিছু প্রশ্ন রেখে। কী করে বেঁচে আছেন? বাইগার  নদী আপনাদের দু বোনের চোখের জলে  লোনা হয়েছে। দিন আসে দিন যায়, এভাবে বছরের পর বছর, একসময় যুগ অতিক্রম করে, তবুও বদলায় না আপনার পরিশ্রমের মানচিত্র।

আপনার দু’বোনের চোখের জল নদীতে গিয়ে সাগরে মিশে ঢেউ আছঁড়ে পড়ে বালুকাবেলায়। রক্তগঙ্গায় ভেসে গেছে জীবনের চরাচর। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে যায় পদ্মা পেরিয়ে মেঘনায়। আপনাদের শাড়ির আঁচলে ঢেকে গিয়েছে ভাইবোনের রক্তাক্ত মুখ আর বুলেট বিদ্ধ দেহ।

আচ্ছা আপনাদের কি রাগ নেই! ঘৃণা নেই! ক্ষোভ নেই! যে আকাশ বাতাস কেড়ে নিলো এক নিমিষে আপনাদের সুখের রাজ্য;  তাও সে আকাশের জমিনে উড়িয়ে যাচ্ছেন শান্তির সাদা পায়রা। আচ্ছা, আপনি তো পাথর নন! রক্তমাংসে গড়া মানুষ, তাহলে কি করে সইছেন এত শোক?  বুকে চাপা দিয়ে রেখেছেন কত সহস্র ধূলি মাখা ধূসর স্মৃতি। আপনার স্বজনেরা নিথর হয়ে পড়ে আছে মাটির সাথে মিশে, যেখানে গজিয়ে উঠেছে সবুজ দুর্বা ঘাস। যেন মনে হয় জামাল, কামাল, রাসেলেরা তারুণ্যে ছুটে বেড়ায়। ওদিকে পিতা সবাইকে ছেড়ে একা শুয়ে আছেন নিজ ভূমে। আপনাদের দু’জনের কাছে আমার আবার ও প্রশ্ন, কী করে বেঁচে আছেন? কী করে সইতে পারেন? আমাদের প্রার্থনায়  বেঁচে থাকবেন আপনার স্বজনেরা।

পিতা, যে আপনি সকলের দুঃখ ঘুচে দেবার জন্য পরিশ্রম করতেন, ভিক্ষুককে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে মালা পরিয়ে দিতেন। সে আপনি কোথায় আছেন, কতদূরে? জানেন কি পিতা, আপনার দুই কন্যা আপনাকে হারিয়ে শোকার্ত হয়ে শক্তি অর্জন করেছেন! বাস্তবায়ন করে চলেছেন আপনার সোনার বাংলার স্বপ্ন। পিতা যেখানে আছেন, শুনতে পাচ্ছেন তো বাংলাদেশের এগিয়ে যাবার গল্প ?

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা