• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখল করেছে নওগাঁ’র নারীদের হাতে তৈরি টুপি

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০২২  

ঘরে কিংবা বাড়ির উঠানে হাসি-ঠাট্টা আর খোশগল্পের মাঝেই নিপুণ হাতে টুপির কারুকাজে ব্যস্ত এক দল নারী। মধ্যপ্রচ্যের দেশ ওমানে গিয়ে এই টুপি হয়ে যায় ‘কুপিয়া’। দেশটির জাতীয় টুপিকে এ নামেই ডাকা হয়।
শুধু ওমান নয়, নওগাঁর নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপি পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। মানভেদে একেকটি টুপি দেড় থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রমজান আর ঈদুল ফিতরকে ঘিরে টুপি তৈরির কারিগররা এখন দারুণ ব্যস্ত। সাদা কাপড়ে তাদের সুইয়ের ফোঁড়ে ফুটে উঠছে নান্দনিক নকশা। পরে বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজে এই কাপড়ই হয়ে যাচ্ছে টুপি।
বোতাম, চেন, দানা ও মাছকাটা নামে চার ধরনের টুপি সেলাই করা হয়। কয়েক হাত বদলের পর একটি পূর্ণাঙ্গ টুপি তৈরি হয়। টুপির মধ্যে বেশি সময় ও পরিশ্রম হয় দানা সেলাইয়ে। টুপি ব্যবসায়ীরা টুপি তৈরির সব উপকরণ কারিগরদের সরবরাহ করেন।
মহাদেবপুর উপজেলার ভালাইন, মধুবন, কুঞ্জবন, খাজুর, রনাইল, খোসালপুর, সুলতানপুর, উত্তরগ্রাম শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি এবং তাতারপুরসহ অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি গ্রামে বিভিন্ন বয়সী নারী বিশেষ ধরনের এসব টুপি তৈরি করছেন।
জানা গেছে, প্রায় একযুগ আগে জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় টুপি ব্যবসা শুরু করেছিলেন ফেনীর একদল ব্যবসায়ী। পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তারা। এসব টুপির কারিগর মূলত নারীরা।
এদিকে যে দেশের জাতীয় টুপি বানানো হচ্ছে সেই ওমান দেশটি কোথায় তা ঠিকভাবে জানেনও না অনেক নারী কারিগর। টুপিগুলো তৈরির পর ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এগুলো রপ্তানি করেন।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার রনাইল গ্রামের গৃহবধূ তাসলিমা বেগম বলেন, ‘হামার স্বামী রাজমিস্ত্রি। দুডা ছোট ছোল আছে। একটার বয়স ৫, আরেকটার ৩। গত ৫ বছর ধরা টুপি তৈরির কাম করিচ্ছি। পাশের বাড়ির এক ভাবির কাছে থাকা টুপি তৈরির কাম শিখিছি। প্রতিডা টুপিত থাকা ২০ থেকে ২৫ টাকা করা পাই। এই টাকা সংসারে ব্যয় করি।’
উপজেলার কুঞ্জবন গ্রামের গৃহবধূ জুলেখা বিবি জানান, তিনি প্রায় ১২ বছর স্থানীয় এক ধানের চাতালে কাজ করেছেন। কিন্তু খুব কঠিন বলে চাতালের কাজ একসময় বাদ দেন। পরে কী করা যায়- এমন ভাবনা থেকেই জড়িত হন টুপি সেলাইয়ের কাজে। একটি সেলাই মেশিন কিনে প্রথমে টুপির নকশা তৈরির কাজ শিখেন তিনি।
জুলেখা আরও জানান, প্রতিটি টুপি সেলাইয়ে প্রায় আধাঘণ্টা সময় লাগে। প্রতি টুপিতে মজুরি পান ২০ থেকে ২৫ টাকা। এরপর ওই সেলাইয়ের মাঝে সুই দিয়ে মোটা সুতা ঢুকানো হয়। এতে মজুরি ১৫ টাকা। এভাবে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মতো আয় হয় তার। এই আয় দিয়েই সম্প্রতি আধাপাকা পাঁচ কক্ষের একটি বাড়িও নির্মাণ করেছেন। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
উপজেলার তাতারপুর গ্রামের রাহিমা বেগম বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাস আর ঈদের সময় টুপির চাহিদা বাড়ে। তাই এখন কাজের চাপ বেশি। এই টুপি তৈরি করে সংসারের খরচে স্বামীকে সহযোগিতা করছি। ঘরে বসে না থেকে সংসারের কাজের পাশাপাশি এই টুপি তৈরির কাজ করে লাভবান হচ্ছি। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে কাজটি করছি। স্বামী অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করে। সবমিলে সংসার মোটামুটি ভালোই চলে যাচ্ছে।’
প্রায় ১২ বছর ধরে টুপির ব্যবসা করছেন উপজেলার আমজাদ হোসেন। তিনি জানান, প্রতিবেশীর দেখাদেখি তিনি এ পেশায় আসেন। এখন তার অধীনে ১৪ জন অ্যাজেন্ট আছেন। তারা বিভিন্ন গ্রামের নারী কারিগরদের দিয়ে কাজ করিয়ে টুপি নিয়ে আসেন।
স্থানীয় মহাজনদের কাছে প্রতি সপ্তাহেই ২০০টি টুপি বিক্রি করেন আমজাদ। প্রতি টুপিতে লাভ করেন গড়ে ১০০ টাকা।
আমজাদ আরও জানান, প্রায় ৪০০ নারী টুপি সেলাইয়ের কাজে যুক্ত। বর্তমানে কিছুটা মজুরি বেড়েছে। প্রকারভেদে একেকটি টুপি সেলাইয়ের মজুরি ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত। টুপির কাজ সারা বছরই থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের ৩ মাস আগে থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত টুপির চাহিদা বেশি থাকায় কাজও বেশি হয়।
আমজাদ বলেন, ‘এসব টুপি দেশের বাইরে চলে যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে। আমরা সরাসরি সে দেশে না পাঠিয়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছে সামান্য লাভে বিক্রি করি। উপজেলায় আমার মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। এ ব্যবসা লাভজনক। তবে ভালোভাবে তদারকি করতে হয়। কারণ টুপির মান খারাপ হলে বিদেশ থেকে আর অর্ডার আসবে না।’

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা