• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

তিন পাহাড়ি জেলায় নির্মিত হবে ১০৩৬ কিমি. সীমান্ত সড়ক

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ৩ মার্চ ২০২২  

তিন পার্বত্য জেলা-বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির গহিন অরণ্যে অপরাধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য। অপরাধের এই আস্তানা নিশ্চিহ্ন ও দুর্গম সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে ১০৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হলে এ তিন পাহাড়ি জেলার অপরাধ অভয়ারণ্যে আসবে অভিনব পরিবর্তন। কমে আসবে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে এই পার্বত্য অঞ্চলটি।

জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের ৫৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সঙ্গে। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে রয়েছে ৩৩০ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে প্রায় ২১০ কিলোমিটার সীমান্ত। বান্দরবানের সঙ্গে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সীমানা। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সঙ্গে ভারতের সীমানা। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো খুবই দুর্গম। যেসব এলাকায় এখনো বিজিবি কিংবা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছাতে পারে না। এ সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম সীমান্ত এলাকাগুলো মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দুর্গম এবং অরক্ষিত এসব এলাকায় বিভিন্ন উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীরা অবস্থান করে।

আরও জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহস্রাধিক সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি গ্রুপে। তাদের হাতে রয়েছে, অত্যাধুনিক ও ভারী অস্ত্র। এসব অস্ত্রধারী দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা গেঁড়েছে। সেখানে অস্ত্র ও মাদক মজুত নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। এরাই মূলত পাহাড়ি এলাকাকে অশান্ত করে তোলার চেষ্টা চালায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অভিযানে অস্ত্রধারী এসব সন্ত্রাসী ধরা পরলেও থামছে না এদের তৎপরতা। গত এক বছরে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এলাকায় ৩০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব গ্রুপ সক্রিয় সেগুলো হচ্ছে-পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (শন্তু লারমা গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (লারমা সংস্কার গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (সংস্কার গ্রুপ) ও মগ লিবারেল ফ্রন্ট। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে এসব গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে প্রায় সময়েই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

বিজিবি সূত্র জানায়, দুর্গম পাহাড়ি পথে দুর্গমতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে লাগাতার টহলে যাওয়া সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তরেখায় বাংলাদেশের নজরদারি পাকাপোক্ত করতে ১০৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিন ধাপে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে প্রথম ধাপে ৩১৭ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

যোগাযোগ করা হলে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কর্মকর্তা কর্নেল সাইফুর রহমান সাইফ বলেন, কাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলা সম্ভব নয়।

সূত্র জানিয়েছে, প্রথম ধাপে থেগামুখ-রাজস্থলি পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক, সাজেক-থেগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার সড়ক, সাজেক থেকে বেতলিং পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার এবং উখিয়া থেকে ফুলতলী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ চলছে।

জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেছেন, দুর্গম সীমান্ত এলাকায় চাইলে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া যায়, ড্রোন দিয়ে নজরদারি করা যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তো আর দুষ্কৃতকারী কিংবা চোরাচালানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ শুরু করেছে। সীমান্ত সড়ক যখন হয়ে যাবে, তখন আমাদের নতুন বিওপির মাধ্যমে যখন-তখন আমাদের অরক্ষিত সীমান্তগুলো সুরক্ষিত করতে পারব। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে আমাদের সুবিধা হবে। সীমান্ত সড়ক চালু হলে সীমান্তে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে এ জেলার ১৪৪ কিলোমিটার এবং ভারতের সঙ্গে ৪৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৮ কিলোমিটার সীমান্ত এখনো অরক্ষিত। দুর্গম ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো যোগাযোগ নেই, এমনকি বিজিবিরও কোন ফাঁড়ি নেই।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আখতার যুগান্তরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুভমেন্টটা খুব বেশি জরুরি। আমি যত দ্রুত মুভ করতে পারব, তত দ্রুত মানুষকে আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা দিতে পারব। বান্দরবানের অধিকাংশ এলাকাই দুর্গম। কোথাও কোথাও হেঁটে যেতে হয়। এভাবে অভিযান পরিচালনা, প্যাট্রল ডিউটি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজরদারির বিষয়টা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ সুযোগে অপরাধীরা দুর্গম এলাকায় অনেক সময় আশ্রয় নেয়। তিনি বলেন, সীমান্ত সড়ক চালু হলে, দুর্গম এলাকায় দ্রুত পৌঁছানো যাবে। বিভিন্ন অপরাধ বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তাছাড়া পাহাড়িদের জীবনমানেও পরিবর্তন আসবে।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন মঙ্গলবার বলেন, সীমান্ত সড়ক হলে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। কমে আসবে পাহাড়ি জনপদে অপরাধের মাত্রা। যেসব দুর্গম এলাকায় এখন অভিযানে যাওয়া সম্ভব হয় না, সড়ক হলে তখন ওইসব এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুভমেন্ট যখন বাড়বে, তখন অপরাধ তৎপরতা অনেকটাই কমে আসবে। সীমান্ত সড়ক চালুর পাশাপাশি পার্বত্য জেলায় ৩টি স্থলবন্দর চালু হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ওই অঞ্চলে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ঘটবে। পরিবর্তন আসবে মানুষের জীবনমানেও। সীমান্ত সড়ক চালু হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে এমন আশাবাদী খাগড়াছড়ি পুলিশও।

সূত্র বলছে, পাহাড়ের গহিন অরণ্যের কারণে বান্দরবানের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ২৮ কিলোমিটার এলাকা সবচেয়ে বিপজ্জনক ও অরক্ষিত। এই সীমান্তকে আরও স্পর্শকাতর করেছে রোহিঙ্গা সংকট। তাছাড়া পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে এই সীমান্ত ঘিরে মজুত করে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিবেশী দেশের ভেতরে অবস্থান করছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এলাকা দুর্গম হওয়ার কারণে পাহাড়ে অস্ত্রের কারখানা গড়ে উঠছে। অস্ত্র, মাদকের ব্যবসায় তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা, রাঙামাটির জুরাইছড়ি, বরকল, রাজস্থলি উপজেলা এবং কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা ও খাগড়াছড়ির বাঘাইছড়ির শেষপ্রান্ত দিয়ে নির্মিত সীমান্ত সড়ক চালু হলে অপরাধীদের ঘাঁটি সহজেই নিশ্চিহ্ন করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সীমান্ত সড়ক পুরোটা নির্মাণ সম্পন্ন করতে অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে।

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা