• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের সাতক্ষীরা

যুগে যুগে বাইতুল্লাহর সফর

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২৮ জুলাই ২০২০  

বাইতুল্লাহর সফর চলমান আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। তবে সেকাল আর একালের সফরের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান হচ্ছে, সফর ও সফরকারীদের অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। অর্থাৎ সেকালে সফরের রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। কিন্তু মুসাফির তথা হজব্রত পালনকারীরা ছিলেন পাকা। আর বর্তমানে সফরের জন্য রাস্তাঘাট হয়েছে পাকা। আর মুসাফির বা সফরকারীরা হয়ে গেছেন একদম ‘কাঁচা’। 

সেকালে পথ পরিক্রমার অবস্থা ছিল ভীষণ করুণ ও বিপদসঙ্কুল, দুর্গম, মেঠে, পাহাড়ী। সেকালে (খুব বেশিদিন আগে নয়) পাকিস্তান বা হিন্দুস্তান থেকে সমুদ্রপথে জেদ্দা নাগাদ পৌঁছতেই দুই তিন মাস লেগে যেত। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে তো সেই সময় আরো বেড়ে যেত। কারণ, নৌজাহাজ চলন্ত অবস্থায় সামুদ্রিক ঝড় শুরু হলে তুলনামূলক নিরাপদ কোনো স্থানে জাহাজ নোঙ্গর করে রাখতে হত। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ এমনকি কখনও বা (ঝড়ো মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ায়) মাসাধিক কাল পর্যন্ত একই স্থানে কাটাতে হত। এই দীর্ঘ সময় বিরূপ পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একই স্থানে জাহাজের মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় অবস্থানের ফলে যাত্রীদের যে কী করুণ অবস্থার তৈরি হত তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আল্লাহু আকবার!

সবার মাঝে সামুদ্রিক রোগবালাই শুরু হয়ে যেত। জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতা, পাতলা পায়খানা প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়ে সবাই কাহিল হয়ে পড়তো। উন্নত বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় অবস্থা আরো জটিল ও করুণ হয়ে উঠত।

অসম্ভব গরমের কথা তো বলে শেষ করা যাবে না। চারিদিক থেকে ঘেরাও পানির মাঝে বদ্ধ জাহাজের ভেতর দীর্ঘ সময় বসে থাকা মানে কেয়ামতের দিন হাশর শুরু হয়ে যাওয়া। আর যদি হয় গরমকাল তাহলে তো কোনো কথাই নেই। সেই করুণ অবস্থার দৃশ্য বর্তমান যুগের মানুষ তো কল্পনাই করতে পারবে না। তাই তখন হজব্রত পালনে পবিত্র রমজান মাসের অনেক আগেই রওয়ানা করতে হত। তা না হলে যথাসময়ে সেখানে হজব্রত পালন করা সম্ভব হতো না। 

এত বড় কঠিন, কষ্টকর দুর্বিষহ সফর শেষে জেদ্দায় পৌঁছার পর শুরু হত অন্য রকম জীবন যুদ্ধ। কষ্ট-কাঠিন্যের সঙ্গে যোগ হয় নতুন মাত্রা। আমাদের প্রিয় মুর্শিদে আলম (রহ.) বলেছেন, জাহাজ জেদ্দা বন্দরে নোঙ্গর করার পরও তিনদিন পর্যন্ত কোনো যাত্রীকে জাহাজ থেকে নামতে দেয়া হতো না।

সবার শারীরিক চেকআপ শেষ করে তিনদিন পর তাদের জেদ্দা বন্দরে অবতরণ করতে অর্থাৎ জাহাজ থেকে নামতে দিত। এর পেছনে প্রধানত দু’টি কারণ থাকত ১. ভালো করে চেক করে দেখা, কোনো যাত্রী অসুস্থ রয়েছে কি না? থাকলে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা আর ২. দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সামুদ্রিক আবহাওয়া থেকে স্থল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বা মানিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ সামুদ্রিক আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া শরীরকে আরবের শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ার উপযোগী করে তোলা। তবে কূলে এসেও তীরে নামতে না পারার ছটফটানিটাও কম বেদনাদায়ক আর বিরক্তিকর নয়।

এরপর জেদ্দা থেকে মক্কা শরিফ পৌঁছুতে শুরু হয়ে যেত আরেক যুদ্ধ। সে যুগে পিচঢালা পাকা সড়কপথ তো দূরেই থাক, কাঁচা কোনো সমতল সড়কপথও ছিল না আরবে। খানাখন্দক, পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে হত। সমতল শীতল ভূমিতে জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষদের সামুদ্রিক আবহওয়া থেকে বের হয়ে লু হাওয়ার মাঝে এবড়োখেবড়ো পথে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা যেমন কঠিন ও কষ্টকর, তার চেয়ে বেশি কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে সামানাপত্র নিয়ে পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসা।

যদিও হিসেবের দিক দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ মাইল পথ। কিন্তু ভিনদেশি মুসাফিরদের জন্য তা কয়েকশত মাইলের শামিল। সে যুগে বাহনের ব্যবস্থা ছিল একদম অপ্রতুল। স্থানীয়দের কাছে স্বল্প পরিমাণ উট থাকলেও তাতে আরোহন করা ছিল অসম্ভব। কারণ একে তো পর্যাপ্ত পরিমাণ যাত্রীবাহী উট পাওয়াই যেত না, তার ওপর আবার অস্বাভাবিক চড়া ভাড়া। যা দিয়ে উটে আরোহন করতে গেলে দেখা যেত সব সম্বল শেষ। তাই বাধ্য হয়েই কয়েকজন মিলে একটি উট ভাড়া নিয়ে তাতে আপাতত সামানাপত্রগুলো নিয়ে তাদের পদব্রজে যেতে হত। 

এই মাত্র পঞ্চাশ মাইল পথ মাড়িয়ে জেদ্দা থেকে মক্কা শরিফে পৌঁছতেই তিনদিন পার হয়ে যেত। এই দিনে আবার পথিমধ্যে কোনো পানি পাওয়া যেত না। প্রয়োজনীয় পানি নিজের কাছেই রাখতে হত। একটু ভেবে দেখুন, ইস্তেঞ্জা মেরে পবিত্রতা অর্জন করতে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন হত। গোসলের কথা না হয় বাদই রাখলাম ওজু করতে কত পানির দরকার? তীব্র রোদের প্রচণ্ড গরমে পান করার জন্য লাগত কত পরিমাণ পানি? এই পরিমাণ পানিও সঙ্গে রাখতে হত। আরো কষ্টকর ব্যাপার হলো, খাঁ, খাঁ করা পাহাড়ি পথে কোনো গাছপালা বা ছায়ার ব্যবস্থা ছিল না।

ফলে তীব্র দাবদাহের মাঝেই জ্বলে পুড়ে সফর করতে হত। রাস্তায় কোনো চা স্টল, রেস্টুরেন্ট বা হোটেলের ব্যবস্থা ছিল না। যেখানে গিয়ে একটু তৃপ্তিমত আহার করবে। সুপেয় তাজা ঠাণ্ডা পানির তো কল্পনাও করা যেত না। এমনিভাবে অনেক দুঃখ কষ্ট আর দুর্ভোগ পোহানোর পর কাহিল হয়ে পবিত্র মক্কা মুকাররমায় পৌঁছতে হত। এরপর মক্কা শরিফে পৌঁছেও দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটত না।

অভাব অনটন আর অপ্রাপ্তির সঙ্গে আরো যুদ্ধ করতে হত। কারণ সেখানেও খাদ্যদ্রব্য পানীয়ের স্বল্পতাসহ পর্যাপ্ত আবাসন ও টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষ করে আরাফার ময়দানে পানির সংকট দেখা দিত প্রবলভাবে। সেখানে একজনকে আরেকজনের ওপর নির্ভর করে মিলেমিশে চলতে হত। একটু চিন্তা কর দেখুন, তখন কী পরিমাণ কষ্টসাধ্য ছিল হজব্রত পালন করা।

আলহামদুলিল্লাহ! বর্তমান যুগে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য সবকিছুই কতই না সহজ ও আরামদায়ক করে দিয়েছেন! আজ আমরা এসি উড়োজাহাজে চড়ে মাত্র চার ঘণ্টায় জোদ্দায় গিয়ে অবতরণ করি। সেখানেও এসি রুমে ইমিগ্রেশনের সব ঝামেলা অল্প সময়ে সমাপ্ত করে আবার এসি বাসযোগে এসি হোটেলে গিয়ে উঠি এবং বিলাসবহুল হোটেলের আরামদায়ক এসি রুমে বসে বলি, যা! কী ধকলই না বয়ে গেল এই দীর্ঘ ভ্রমণে! মানুষ এতো কষ্ট করতে পারে? আমি ভীষণ টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। একদম ক্লান্ত শ্রান্ত বিধ্বস্ত হয়ে গেছি।

তাই এই মুহূর্তে হেরেম শরিফে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর ঝর্নার শীতল-কোমল পানিতে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে এলিয়ে দিই। এয়ারফ্রেশনার ছিটানো কামরায় পুষ্প মোলায়েম বিছানায়। এরপর দীর্ঘ ঘুম আর বিশ্রামের পর ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকে অন্যান্য কাজের। তো সেকালের হজের সঙ্গে একালের হজের ব্যবধান কোথায়? কতটুকু? সুস্বাদু খাবার। সুপেয় শীতল কোমল পানীয় আরামদায়ক সব ইন্তেজাম কী নেই হাতের মুঠোয়? যা দেখে আপনা আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে আসার কথা কে আছে তোমরা আল্লাহ তায়ালার কোনো নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? 

তো এক কথায় বলা যায়, সেকালে (হজের জন্য) যাত্রাপথ হয়েছে পাকা আর যাত্রীদল হলো কাঁচা। এত কষ্ট করা সত্তেও আমাদের পূর্বসূরীরা সেখানে পৌঁছেই সবকিছু বাদ রেখে আগে তাওয়াফ জিয়ারতসহ সব ধরনের ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেতেন।

আর একালে আমরা বিলাসবহুল বাহনে স্বল্পসময়ে সেখানে পৌঁছার পর আরামদায়ক হোটেলে উঠে অত্যাধুনিক মনোরম সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে ফ্রেশ হয়ে রসনা মিটিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিই মোলায়েম কম্বলের মাঝে, আজান শোনার পর প্রস্তুতি নিতে যাই নামাজের। যার কারণে হেরেম শরিফ পৌঁছার আগেই শেষ হয়ে যায় জামাত। বড়জোর ধরতে পারে শেষের রাকাত। এই হলো আমাদের অবস্থা। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ এর উল্টো।

কষ্টের পর কেষ্ট লাভ:

আমাদের আকাবের তথা পূর্বসূরী বুযুর্গানে কেরাম আগে কষ্ট করে পরে কেষ্ট চাইতেন। আগে মুজাহাদা করতেন, তারপর ফলের প্রত্যাশা করতেন। মুজাহাদা নেই তো মুজাহাদাও নেই। যেভাবে পারতেন, সেভাবেই কোনো মতে দিন কাটিয়ে দিতেন। মনে কোনো রকম পরিবর্তন অনুভব করতেন না। বরং নিজের অন্তরে কোনো কিছুর অনুভব না জাগার অনুযোগ করতেন। কোনো কবি যেমন বলেছেন, আমি কী করব? আমার চোখের ওপর তো পট্টি বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে আমার আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। 
চক্ষুষ্মানরাই কেবল তোমার জালওয়ার তামাশা দেখতে পাবে। অন্ধ ব্যক্তির দেখা না দেখাতে কী এসে যায়?

ক্ষুধার কষ্ট:

আমার শায়েখ বলতেন, সেখানে খুব ক্ষুধার কষ্ট ছিল। এমনকি আমরা তরমুজ খেয়ে তার খোসা ফেলে দিলে তা কুড়িয়ে খাওয়া নিয়ে স্থানীয় বস্তির ছেলেদের মাঝে প্রতিযোগিতা ও ঝগড়া মারামারি লেগে যেত। সেখানে এতটাই ক্ষুধা দারিদ্র বিরাজ করত যে, পথে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে সবাই সংঘর্ষে পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ত। আমি একবার পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে মদিনা শরিফ যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে এমন এক অসহায় বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম যে হাতে ইশারা করে বুঝাতে চেষ্টা করছে সে খুব ক্ষুধার্ত। কয়েকদিনের অনাহারী। আমি সেখানে যাত্রাবিরতি দিয়ে আমার স্ত্রীকে বললাম, যেহেতু আমাদের কাছে এখন প্রস্তুতকৃত খাবার নেই, তাই চুলা জ্বালিয়ে রুটি পাকিয়ে বেচারাকে একটু খেতে দাও। অতঃপর আমার স্ত্রী ব্যাগ থেকে গমের আটা বের করে যেইমাত্র তা খামির করতে যাবেন এমন অকস্মাৎ সেই বৃদ্ধ তার হাত থেকে আটার প্যাকেট নিয়ে এক খাবলা আটা বের করে গ্লাসে নিয়ে তাতে পানি ঢেলে অতি দ্রুত গুলে ফেলল এবং কালবিলম্ব না করে ঢকঢক করে গিলে ফেলল। আমরা বিস্ফোরিত নেত্রে তার কাণ্ড কারখানা দেখছিলাম। এরপর তৃপ্তির ঢেকুর নিয়ে বলল, আচ্ছা বাজান! আমি এখন আপনার রুটি তৈরি করে তা পাকানোর সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারব। আল্লাহু আকবার! কেমন প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগার পর মানুষ রুটি তৈরি করার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। কাঁচা আটাই পানিতে গুলে খেয়ে বলে, এখন আমি রুটি পাকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব। কিন্তু এত কষ্ট করেও তারা বাইতুল্লাহ শরিফে থেকে তার বরকত লাভে সচেষ্ট থাকে।

সংগ্রহে: হাবীবুল্লাহ সিরাজ

 

আজকের সাতক্ষীরা
আজকের সাতক্ষীরা